মো. শাকিল আহমাদ, চবি
চবিতে তেপান্তরের সেমিনার
তেপান্তর সাহিত্য সভা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত ‘গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী শিক্ষা ও সাহিত্য ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারটি রবিবার (৬ অক্টোবর) বেলা ৩টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সেমিনারে প্রশিক্ষণ সম্পাদক মো. রিয়াদ উদ্দিনের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন তেপান্তর সাহিত্য সভার সভাপতি মো. শাকিল আহমেদ। সভাপতি স্বাগত বক্তৃতার শুরুতে উপস্থিত সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানান। সে সঙ্গে ২৪ গণ-অভ্যুত্থানে নিহত হওয়া সব বীর শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ ও তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। সাহিত্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা জানার ও সংরক্ষণের একটি বড় মাধ্যম হলো সাহিত্য। মানবতার জাগরণ, স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রেরণা দান, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন সাধন এবং শিক্ষার সার্বিক বিকাশ সাধনের জন্য মানুষকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তোলাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে শিক্ষা ও সাহিত্য নিয়ে ভাবনা তোলে ধরেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যে ভিন্নতা আছে, সেটি থেকে বেরিয়ে সামাজিক, ধর্মীয় ও জাতিগত মূল্যবোধ ধারণ করে এ রকম একটি একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ফিরে আসতে হবে।’ এ ছাড়া শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির নিষিদ্ধ চাচ্ছেন অনেকে। আমি এটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছি। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখে রাজনীতির চর্চার মাধ্যমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া আদায়ে সোচ্চার থাকতে পারব।’ একই বিষয়ে আরেক শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস রিতা শিক্ষার গুণগত সংস্কারের দাবি জানান।
এরপর সেমিনারের আলোচকদের মধ্যে প্রথমে আলোচনা রাখেন, বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আর রাজী স্যার। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা আর বিদ্যা এক জিনিস নয়। আমরা আলোচনা করছি গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষা তো দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত এর সঙ্গে বিদ্যার সম্পর্ক কতটুকু? বিদ্যা শব্দটি বিদিত হওয়ার সঙ্গে রিলেটেড। আমরা মূলত বিদ্যালয় তৈরি করেছি, শিক্ষালয় না। বিদ্যা দেওয়াটাই আমাদের সমাজের আকাঙ্ক্ষা।’ এ ছাড়া তিনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে যা যা প্রয়োজন তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
এরপর আলোচনা করেন লেখক, অনুবাদক ও বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লার সহকারী অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ। তিনি শিক্ষা ও সাহিত্য ভাবনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই ছাত্র অভ্যুত্থান শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগ আনেনি, এনেছে শিল্প, সাহিত্য ও শিক্ষাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার উপলক্ষও। ২৪-এর ছাত্র-অভ্যুত্থান আমাদের সাহিত্যের গতিপথ বদলে নেবার একটা বার্তা দিয়েছে। গল্প, কবিতা ও নাটকে নতুন ভাবনার উদয় হবে এখন থেকে। যে সাহিত্য সময়কে ধারণ করে না, সামাজিক ভাবনাকে ইতিবাচক অর্থে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ, সে সাহিত্য আখেরে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত হবে। তিনি আরো বলেন, ‘ব্লগ, অনলাইন প্ল্যাটফরম, লিটলম্যাগাজিন এবং সর্বোপরি ফেসবুকে লেখালেখির গুরুত্ব আমাদের নতুন করে উপলব্ধি করিয়েছে যে আপনি হক কথা যে মাধ্যমেই বলুন লোকে তা নেবেন। ফেসবুক হয়ে উঠেছে প্রতিবাদী সাহিত্যচর্চার অন্যতম মাধ্যম। সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। তাই, ফ্যাসিবাদের সমর্থক না হয়ে লেখকদের উচিত মানুষের কথা তুলে ধরা। যে সাহিত্য মানুষের দুঃখ, বঞ্চনা ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে নয়, সে সাহিত্য আখেরে মুড়ির ঠোঙা হয়ে যাবে।’
সর্বশেষ আলোচক হিসেবে কথা বলেন লেখক, অনুবাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জিএইচ হাবিব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেন, ‘যদি শিক্ষার্থীদের পছন্দ আর আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কর্মসংস্থান আর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত থাকত তাহলে কতজন শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেন? কেউ হতেন না। বরং ওই সুবিধা লুফে নিতে চাইতেন।’ তিনি দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকসংকটের বিষয়টিও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সবক্ষেত্রেই শিক্ষকসংকট। রাষ্ট্র চাইলেই এই সংকটের সমাধান করতে পারত। রাষ্ট্র তা করছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বড় অংশ বই পড়া থেকে দূরে। বর্তমান শিক্ষার্থীরা নোট সিটনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষার যে কাঙ্ক্ষিত মান, সেটি আর হচ্ছে না। একই সঙ্গে শিক্ষকদের মধ্যেও বই পড়ার প্রবণতা কমে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি মনে করেন, শিক্ষার গুরুত্ব আমরা বুঝি না বলেই শিক্ষার আজ এই অবস্থা।
সেমিনারে আলোচনা পর্ব শেষে প্রশ্নত্তর পর্ব শুরু হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যবিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন করেন শিক্ষার্থীরা। আলোচকরা খুবই প্রাণবন্তভাবে উত্তর দেন। সে সঙ্গে সেমিনার থেকে ওঠে আসে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী শিক্ষা ও সাহিত্য নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা।
সর্বোপরি, বিজ্ঞ আলোচক ও শিক্ষার্থীদের যৌথ অংশগ্রহণে সেমিনারের পুরোটা সময় দারুণ উপভোগ্য ছিল। শিক্ষা ও সাহিত্য নিয়ে ব্যতিক্রম এই আলাপচারিতা, মুগ্ধ করেছে সবাইকে। স্যারদের চমৎকার আলোচনার মাধ্যমে নতুন নতুন অনেক কিছু জানার ও শেখার সুযোগ হয়েছে। শিক্ষণীয় এই সেমিনারটি সত্যি স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন। এ রকম আয়োজন সামনে আরো হোক, এই প্রত্যাশা রইল।
"