মো রিয়াজ হোসাইন, বাকৃবি
সংগ্রামে স্মৃতিতে বাকৃবির ‘বিজয় ১৯৭১’
বাংলার ইতিহাস গৌরব ও সংগ্রামের ইতিহাস। শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এই দেশে সাধারণ মানুষ সর্বদা প্রতিবাদী ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহের ইতিহাস রয়েছে, যার মধ্যে সিপাহি বিদ্রোহ অন্যতম। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে বাংলার মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার বীজ বপন হয়। দেশভাগের পর পাকিস্তানিরা এই দেশে শোষণ করতে এলে, মুক্তিকামী জনতা চুপ করে থাকেনি। এর প্রমাণ মেলে ১৯৪৮-এর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়, ছাত্রদের ১১ দফা দাবিভিত্তিক ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে। এই ধারাবাহিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, যার ফলে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং ৩০ লাখ বীর সন্তানের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অসাধারণ এবং তাদের আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯৬তম ব্রিগেড তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। মুক্তিকামী জনগণের অংশগ্রহণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, যার মধ্যে ১৯ জন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। তাদের মধ্যে ছিলেন একজন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৬ জন কর্মচারী। এই শহীদরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি হলের নামকরণ করা হয়েছে, যথা শহীদ নাজমুল আহসান হল, শহীদ জামাল হোসেন হল এবং শহীদ সামছুল হক হল। তাদের বীরত্বের স্মৃতি রক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ‘বিজয় ১৯৭১’ ভাস্কর্যটি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিসংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে।
‘বিজয় ১৯৭১’ ভাস্কর্যটি নেত্রকোনার খ্যাতিমান ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী দক্ষ হাতে নির্মাণ করেন। ১৯৯৭ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০০০ সালের জুন মাসে তা সম্পন্ন হয়। ভাস্কর্যটির নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২৪ লাখ টাকা। বেদির উচ্চতা ৬ ফুট এবং তার ওপর স্থাপিত বিপ্লবী তিন শ্রেষ্ঠ সন্তানের উচ্চতা ১০ ফুট। বেদির আস্তরণে মার্বেল পাথরের ওপর চিত্রিত করা হয়েছে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৬৬-এর ছয় দফার নান্দনিক দৃশ্য, যা নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বিপ্লব ও সংগ্রামের শিক্ষা দেয়। ভাস্কর্যে তিন পেশাজীবী মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যাদের মধ্যে একজন নারী, একজন ছাত্র এবং একজন কৃষক। কৃষকের হাতে উড়ন্ত পতাকা স্বাধীন বাংলার শাশ্বত রূপ তুলে ধরে। গ্রেনেড ছোড়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ছাত্র এবং বাম হাতে রাইফেল নিয়ে একজন সংগ্রামী নারী মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছেন।
বিজয় ১৯৭১-এর মাধ্যমে স্বাধীন বাংলার শোষণ থেকে মুক্তির প্রতীকী চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উজ্জীবিত করে। বাকৃবি মূল ফটক থেকে সোজা অগ্রসর হলে ভেটেরিনারি গেটের পেছনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন অডিটোরিয়ামের পাশে বিজয় ৭১ ভাস্কর্যটি অবস্থিত। এর পাশেই রয়েছে ঘন সাড়ি সাড়ি দৃষ্টিনন্দন ঝাউগাছ, যা এর সৌন্দর্যকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাজারো সংগ্রামের পদযাত্রার স্মৃতি এখানে জড়ানো। ক্যাম্পাসের সমস্ত আন্দোলনের হাতেখড়ি এখান থেকেই শুরু হয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিকট শান্তির একটি পবিত্র স্থান। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বিজয় ৭১ চত্বর সব সময় ব্যস্ত থাকে। তারা নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলা, কবিতা আবৃত্তি এবং গল্প-কবিতা লেখায় মগ্ন থাকে।
এক ভ্রমণকারী বলেন, ‘বিজয় ১৯৭১ আমাদের সংগ্রামের এবং দৃঢ় মনোবলের প্রতীক, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সব সময় প্রেরণা দিয়ে যাবে। আমার মন খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে এখানে এসে ঘুরে যাই।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নত একজন শিক্ষার্থী জানান, বিজয় ১৯৭১ ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছে। ভাস্কর্যটি মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের চেতনা ধারণ করায় শিক্ষার্থীদের মাঝে গভীর দেশপ্রেম, বীরত্ব এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক বহন করে।
"