বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে একটি উপজেলা গলাচিপা। ৯২৬ বর্গকিমি আয়তনের এই উপজেলার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আলোর দিশারি হয়ে এসেছিলেন ইউএনও মহিউদ্দিন আল হেলাল আবার সবাইকে কাঁদিয়ে চলেও গেলেন। গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দিনরাত এক করে কাজ করেছেন। মানুষকে সেবা দিয়ে ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করেছেন। সেবা দিয়ে পরপর দুবার শ্রেষ্ঠ ইউএনও এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি শুদ্ধাচার পুরস্কারও পেয়েছেন। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের দক্ষ, মেধাবী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করেছেন। তাই তো তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখবে গলাচিপাবাসী।

২০২২ সালের আগস্ট মাসে গলাচিপা উপজেলার ইউএনও হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পান তৎকালীন দশমিনা উপজেলার ইউএনও মহিউদ্দিন আল হেলাল। এর কিছুদিন পরেই ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গলাচিপা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তাকে পদায়ন করা হয়।

দুই বছরের কর্ম সময়ে তার কাজের উল্লেখযোগ্য- ভূমিহীনদের বাছাই করে তাদের মাঝে সরকারি ঘর পৌঁছে দেওয়া। তার হস্তক্ষেপে জমি নিয়ে ভাই ভাই ১৯ বছরের বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। উপজেলার সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন এবং ইতিবাচক সহযোগিতা প্রদান। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে সাঁতার প্রশিক্ষণ চালু করা, বাল্যবিয়ে বন্ধে তৎপরতা। অসহায়, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও আর্থিক সহায়তা করা। অসহায় মানুষের বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দেওয়া, নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর স্বার্থে বিভিন্ন জায়গায় কাঠের সেতু নির্মাণ, সামাজিক সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে নিজ হাতে পুকুর, নর্দমা পরিষ্কার করে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ গড়ে তুলেছেন। ঘূর্ণিঝড় ও বিপদের সময় মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সতর্ক করা ও নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া, ঝড়ের মধ্যে নিজে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন স্থানের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রক্ষায় কাজ করা, উপজেলায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি অনিয়ম প্রতিরোধে ভূমিকা রেখেছেন।

সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন, উৎসবমুখর ও জাঁকজমকপূর্ণ বৈশাখী মেলার আয়োজন, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও মেধা বিকাশে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও সেমিনার আয়োজন, বাজার মনিটরিং, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে হেলমেট পরিধান নিশ্চিত, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, কিশোর-কিশোরী ক্লাব সক্রিয় করা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষার আদলে প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা নেওয়া, শিক্ষার্থীদের বাসায় বাসায় গিয়ে পড়াশোনার খোঁজ নেওয়া। বিভিন্ন পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করা ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া ভর্তিকৃত ছাত্রছাত্রীদের সম্মাননা প্রদান করা।

এ ছাড়া গলাচিপা স্কিল ল্যাব স্থাপন, যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য ৮টি কম্পিউটার রয়েছে। উপজেলায় সর্ব প্রথম স্মার্ট গণগ্রন্থাগার উপকূল বাতিঘর স্থাপন, উপজেলাভিত্তিক স্মার্ট অ্যাপ সুরাহা চালু, শিল্পকলা একাডেমি সক্রিয় করা, বিদ্যালয় পর্যায়ে ল্যাংগুয়েজ ক্লাব স্থাপন, শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রোগ্রামিং ও রোবোটিকসের ওয়ার্কশপসহ সেমিনার আয়োজন, উপজেলা পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতা আয়োজন। ইসলামিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা (রমজান মাসে), মাধ্যমিক ও কলেজপর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আন্তঃউপজেলা জেলা প্রশাসক বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপজেলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২৩ আয়োজনসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এমনকি বিদায় মুহূর্তে IoT & Fab lab উদ্বোধন করে যান। তিনি ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা, যা করেছেন তাই বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ক্রীড়া, পর্যটনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দিনটি ছিল গলাচিপায় ইউএনও মহিউদ্দিন আল হেলালের শেষ কর্মদিবস। গলাচিপার মানুষদের কাঁদিয়ে কর্মস্থল থেকে বিদায় নিলেন গলাচিপা উপজেলাবাসীর হৃদয়ের মানুষ, সৃষ্টিশীল এক কর্মবীর ইউএনও। বিদায় বেলায় নিজেও কাঁদলেন। দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ও উপজেলার মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মায়া তাকেও আবেগ-আপ্লুত করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে তার বিদায়কে সম্মান জানিয়ে অশ্রু ঝরিয়েছে সাধারণ মানুষ। স্মৃতি হিসেবে একটি বৃক্ষরোপণ করে গেলেন ইউএনও বাস ভবনে। বিদায় বেলায় ইউএনওকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে অনেকে।

ইউএনও মহিউদ্দিন আল হেলাল ছিলেন সৃষ্টিশীল ও সাধারণের কাছে বিশ্বাস ও আস্থার নাম। উপজেলায় দীর্ঘ দুই বছরের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছেন তিনি। তার হাসিমুখ দেখে সবাই ভরসা পেতেন, কথা বলার সাহস পেতেন। সর্বসাধারণের জন্য তার দরজা সব সময় খোলা ছিল। দারিদ্র্য, নিপীড়িত মানুষ সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেত। তাই তো সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।

"