reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৪ নভেম্বর, ২০২৪

বৃদ্ধাশ্রমের মায়েদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা

মা- এক অক্ষরের একটা শব্দ মাত্র অথচ এর অর্থ ব্যাপক। মা হারা সন্তান জানে মা ছাড়া পৃথিবীতে লড়াই করে টিকে থাকা কতটা কঠিন। শত প্রতিকূলতা উপড়ে ফেলে মা সন্তানকে আগলে রাখে। মা সন্তানদের জন্য বটবৃক্ষ সমতুল্য। অথচ আমরা বটবৃক্ষ উপড়ে ফেলে বিশাল অট্টালিকা গড়ে তুলছি। যে মা জন্ম দিয়েছে, নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছে তাদের ঠেলে দিচ্ছি বৃদ্ধাশ্রম নামক কুঠুরিতে। বৃদ্ধা মায়েরা উপেক্ষিত হচ্ছে সন্তানদের যত্ন, ভালোবাসা থেকে। এই উপেক্ষিত, অবহেলিত মায়েদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কাম ফর রোড চাইল্ড (সিআরসি) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যরা এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এক বেলা তাদের সঙ্গে আহার এবং তাদের জন্য কিছু করতে পেরে যে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন। তাদের অনুভূতি তুলে ধরেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেখা খাতুন

মায়েরা আজ বৃদ্ধাশ্রমে

মা- ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু কী বিশাল তার পরিধি! সৃষ্টির সেই আদিলগ্ন থেকে মধুর এই শব্দটা শুধু মমতার-ই নয়, বরং ক্ষমতারও যেন সর্বোচ্চ আধার। মায়ের সহযোগিতা ছাড়া কোনো প্রাণীরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই মমতাময়ী মায়েদের স্থান আজ বৃদ্ধাশ্রমে চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ। সিআরসির উদ্যোগে বৃহস্পতিবার (২ মে ২০২৪) কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসের সামনে অবস্থিত উদয় মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে আমরা গিয়েছিলাম। যেখানে অবস্থান করছে ৩০ জন হতভাগা মা। এই মায়েদের না আছে কোনো সুন্দর বিছানা না আছে গল্প করার মতো কোনো নাতি-নাতনি। তারপরও এই আশ্রিত স্থানে অনাকাঙ্ক্ষিত দিনগুলোর সাক্ষী হচ্ছেন তারা। যে মা নিজে না খেয়ে সন্তানের খাবারের ব্যবস্থা করেছে সেই মা আজ বৃদ্ধাশ্রমে। যে মা নিজের থেকে সন্তানদের প্রতি বেশি ভালোবাসা দেখিয়েছেন তারাই আজ কি না সন্তানের জন্য বড্ড ‘ভারী বোঝা’। এ এক অদ্ভুত নিয়তি! পশ্চিমা সংস্কৃতির নির্মম ও কলঙ্কময় উপহার আজ হাজার বছরের ঐতিহ্য আর ইসলামের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ দেশ ও মাটির চিরচেনা সামাজিক ও পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে মা-বাবাকে রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে। মানব ও মানবতার প্রতি কি নির্মম উপহাস! আমাদের ভাবতে হবে এক দিন আমরাও বৃদ্ধ হব। আমাদের কোনো বাবা-মায়ের ঠিকানা যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

মো. শাহীদ কাওসার

সভাপতি, সিআরসি ইবি শাখা

বৃদ্ধাদের উপকারের বিনিময়ে আত্মতৃপ্তি অর্জন

বৃদ্ধাশ্রম বলতে সাধারণত বৃদ্ধ মানুষের আশ্রয়স্থলকে বোঝায়। সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃদ্ধাশ্রমের মতো জায়গা তৈরি হয়েছে। মানবতা লালনকারী মানুষজনের সাহায্যের বদৌলতে এই বৃদ্ধাশ্রমগুলো পরিচালিত হয়। কুষ্টিয়া শহরের সাদ্দাম বাজার এলাকায় উদয় মা ও শিশু কেন্দ্র নামে একটি বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন জায়গার অবহেলিত মানুষজনের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেশ পরিচিত। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার সামাজিক ও মানবিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি আশ্রমটিতে দুপুরের খাবার ও উপহারসামগ্রীর আয়োজন করা হয়েছিল। এতে প্রায় ৩০ জন অবহেলিত মানুষের সঙ্গে তাদের সুখ-দুঃখের গল্প শোনার সুযোগ হয়েছে। ওদের দুঃখের ভাগীদার হতে পেরে অন্য রকম এক মানসিক তৃপ্তি কাজ করছে। জীবনে কখনো বিত্তবান হতে পারলে এসব অসহায় ও অবহেলিত মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করব।

মো. মশিউর রহমান

অর্থ সম্পাদক, সিআরসি ইবি শাখা

একটা বিকেল যেন গোটা জীবনের প্রতিচ্ছবি

মানুষ যখন অসহায়ত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, একমাত্র তখনই তাকে অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়। হয়তো ভয়ংকর কিছু যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে জীবনের রেখাগুলো টেনে নিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর মানুষগুলোর অসহায়ত্বের যুদ্ধ একেক রকম হয়। সেই জীবনযুদ্ধের আভাস পাওয়া যায় অসংখ্য পিতা-মাতার দীর্ঘশ্বাসে আবদ্ধ কুঠুরি, বৃদ্ধাশ্রমে। মাত্র একটা বিকেল যেন তাদের পুরো জীবন দেখিয়ে দিল আমাকে। তারা বুঝিয়ে দিল পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে মমতাময়ী আর কেউ নেই, একসময় একটা সংসারের কোনায় কোনায় যার ছোঁয়া ছিল, একটু একটু করে আদর-যত্নে সন্তানকে বড় করে তোলার গল্প বুনেছিল, সেই মা তার সন্তানের থেকে পাওয়া তীব্র অবহেলার পুরস্কারস্বরূপ বৃদ্ধাশ্রমে বসে আকাশের দিকে চেয়ে হয়তো ভাবছে আল্লাহ তুমি আমার সন্তানকে ভালো রেখো। কি অদ্ভুত এই মা চরিত্র! বিশৃঙ্খলার বেড়াজালে, মূল্যবোধের অবক্ষয় কিংবা নৈতিকতার অবসানে, যাদের স্বগৌরবে বেঁচে থাকার কথা ছিল, সেই ‘মা’ আজ জীবনের পথে কি ভীষণ উপেক্ষিত! তবুও তারা চায় তার সন্তান ভালো থাক, সুখে থাক। সবশেষে মহান স্রষ্টার কাছে চাওয়া, এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে যাওয়া মায়েরা বাঁচার মতো করে বেঁচে থাক।

সাইফুন্নাহার প্রেমা

সদস্য, সিআরসি ইবি শাখা

বৃদ্ধাশ্রম না হোক কোনো মায়ের ঠিকানা

বৃদ্ধাশ্রম নামটা শুনলেই আমাদের মন ও মস্তিষ্কে চলে আসে হাজারো নর-নারী যারা বয়সের ভারে সন্তানদের পরিবারের বোঝা হয়ে এখানে বসবাস করেন। বৃদ্ধাশ্রম হলো এমন সমাজব্যবস্থার স্থাপনা, যেখানে মূলত সমাজের চোখে মূল্যহীন বস্তুকে বন্দি করে রাখা হয়। পরিবারের বৃদ্ধ মানুষটি যে আমাদের জন্ম দিয়েছেন, যে আমাদের লালনপালন করেছেন, যার রক্ত পানি করা অর্জিত অর্থে এমন বিলাসবহুল জীবন পেয়েছি, সেই মানুষটাই আজ মূল্যহীন, বয়সের ভারে বোঝা। কি এক অদ্ভুত নিয়তি! বর্তমানে দেখা যায় বড় বড় অফিসার ব্যবসায়ী বা ভালো পর্যায়ের মানুষ তাদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। তাদের শেকড়ের কথা ভুলে যায়। যে শেকড় বা বাবা-মা না থাকলে আমাদের জন্ম সম্ভবই হতো না। বৃদ্ধাশ্রমে এক মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তার চার-চারটি সন্তান। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি ছিলেন তার চার সন্তানের মাথার বোঝা। চারজনের কেউ তার বৃদ্ধ মাকে জায়গা দিতে চায় না। অথচ এই মা একটা সময় নিজের বাবার দেওয়া স্বর্ণের গহনা বিক্রি করে সন্তানকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। আজ সে চাকরি করছেন। আর সেই মায়ের বর্তমান অবস্থান বৃদ্ধাশ্রম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কোনো মায়ের অবস্থান এই বৃদ্ধাশ্রমে না হোক। যার মা আছে তার সম্পূর্ণ একটা পৃথিবী আছে। এই পৃথিবীটাকে যত্ন করে রাখা উচিত।

মো. সোহেল হোসেন

সদস্য, সিআরসি ইবি শাখা

মা শব্দের কোনো বিকল্প নেই

দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। সিআরসির উদ্যোগ কুষ্টিয়া মজমপুর বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে দেখি মায়েদের জন্য একটা জীর্ণশীর্ণ, পরিত্যক্ত টিনের ঘর। কথা বলে বুঝতে পারলাম মানসিক প্রতিবন্ধী, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, অন্ধ মায়েরা সেখানে অবস্থান করছে, দেখে মর্মান্তিক কষ্ট অনুভব করলাম। তাদের অস্বস্তিকর পরিবেশ দেখে কাম ফর রোড চাইল্ড (সিআরসি) ইবি শাখা তাদের জন্য শাড়ি-ফ্যান উপহার দিলেন। তারা অত্যন্ত খুশি হলেন। তাদের সঙ্গে গোটা একটা দিন কাটানোর সুযোগ হলো। তাদের প্রতি মায়া এসে গিয়েছিল। যখন আমরা বিদায় নিচ্ছিলাম, তখন তাদের চোখে সন্তানের ভালোবাসা, মায়া দেখেছিলাম। মা খুব যত্নে সন্তানদের আগলে রাখে। নিজের জীবনের শত কষ্টের বিনিময়েও সন্তানদের চাহিদা পূরণ করে ছোট থেকে বড় করে, শিক্ষিত করে অথচ আমরা তাদের কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে তাদের ঠেলে দেই বৃদ্ধাশ্রমে। যে মা সন্তানকে এক দিন না দেখলে ছটফট করত, সে মাকেই এখন কাটাতে হয় সন্তানবিহীন চার দেয়ালের মধ্যে। যে মা যৌবনে পরিশ্রম দিয়ে মানুষ করে। বৃদ্ধ বয়সে দোয়া দিয়ে সন্তাদের সুখে রাখে। এই মায়েদের যত্ন নেওয়া উচিত।

মো. মুরছালিন

দপ্তর সম্পাদক, সিআরসি ইবি শাখা

ভালো থাকুক গর্ভধারণী মায়েরা

কাম ফর রোড চাইল্ড (সিআরসি) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমাজসেবী সংগঠন। এই সংগঠনটি মূলত সমাজে পিছিয়ে পরা সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে থাকে। তবে ২ মে বৃদ্ধাশ্রমের মায়েদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তটি ছিল একটি অসাধারণ চমৎকার আয়োজন। সত্য কথা বলতে একটা গাছ যখন বড় হয়ে ফল দিতে শুরু করে, আমরা তখন শুধু ফলের দিকেই তাকাই। গাছের দিকে তাকাই না। আমাদের মায়েরা হলো আমাদের গাছ। আমাদের উচিত এই গাছগুলোর যত্ন নেওয়া। তাই বৃদ্ধাশ্রমে মায়েদের যত্ন নিতে, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে, তাদের কষ্টগুলোকে উপভোগ করতে সিআরসির এই আয়োজনকে সাধুুবাদ জানাই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। বৃদ্ধাশ্রমে মায়েদের কষ্ট উপলব্ধি করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি, আমরা আমাদের কোনো মাকে এই অবস্থার সম্মুখীন হতে দেব না। পরিশেষে সিআরসি ইবি শাখা চায় ভবিষ্যতে আর কোনো মা-ই যেন বৃদ্ধাশ্রম না যাক। ভালো থাকুক আমাদের গর্ভধারণী মায়েরা।

মো. সাইফুল ইসলাম আলিফ

প্রচার সম্পাদক, সিআরসি ইবি শাখা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close