লামিয়া হান্নান স্নেহা
মায়ার বাঁধনে রায়েরবাজার উচ্চবিদ্যালয়
স্কুলজীবন এমন একটা সময় যখন আমরা বোকা অবুঝ শিশু থেকে একটু একটু করে মানুষ হতে শিখি। এর অবদানে পরিবারের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের অবদান থাকে অসামান্য। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যেই আমি কারো সামনে ঠিকঠাক কথা বলতে পারতাম না, বন্ধু বানাতে পারতাম না। সেই আমিকেই স্কুল একটু একটু করে তৈরি করেছিল ক্লাস ক্যাপ্টিন, মেধা তালিকার পুরস্কৃত একজন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্মার এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিজের স্কুলের নাম নিয়ে অংশগ্রহণকারী। জীবনে শিক্ষকদের মতো করে কেউ কাউকে গড়িয়ে তোলার সুযোগ পায় না। আমরা থাকি মাটির একটা ছোট্ট এলোমেলো টুকরো। আর তাকেই ধীরে ধীরে শিক্ষক ও আমাদের পথের সঙ্গী সহপাঠীরা গড়ে তুলে বিভিন্ন রূপে। কেউ খুব সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে, আবার কেউ একটু একটু করে ভাঙা অংশগুলোকে একত্রিত করে নিজেকে সামলে নেয়, কেউ কেউ আবার ভেঙে যায় এই যাত্রাপথে। কিন্তু দিনশেষে আমরা নিজের একটি নিজস্ব পরিচয় পাই- একটি বিশেষত্ব খুঁজে পাই, বিবেকবোধকে কাজে লাগাতে শিখি, নিজেদের ভুলগুলোকে উপলব্ধি করতে আরম্ভ করি, বাস্তবতাকে শিখতে শুরু করি, হয়ে উঠি বিচিত্র মানুষে।
সম্প্রতি আমি আমার স্কুল রায়ের বাজার উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ অতীতের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম খুব তো আকর্ষণীয় কোনো স্মৃতি নিয়ে এখানে বড় হইনি। তবুও কেন দিনগুলোকে ভেবে নিজের মাঝেই এই অজানা শূন্যতার বিকাশ ঘটল? কিছুক্ষণ ভাবনার ঘরে থেকে বেরিয়ে এলাম। চোখ পড়ল টিচার্সরুমে। বসে ছিলেন তাহাজ্জুদ স্যার, জেবিন ম্যাম, সালমা ম্যাম, পপি ম্যাম, রাজ্জাক স্যার আরো অনেক অনেক পরিচিত মুখ। কিন্তু স্যার ম্যামদের দেখে কেমন যেন মায়া জেগে উঠল। ভাবতে শুরু করলাম তারা আমাদের সময়ও এইরকমই ছিলেন কিন্তু আরেকটু সতেজ লাগতেন, আমাদের মতো করেই হয়তো ছাত্রছাত্রীদের বকুনি দেন আবার আদর করে জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু ওই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আর আমার মধ্যে পার্থক্য হলো- আমরা আমি জানি ওই শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক আবারও খুঁজে পেতে হয়তো মানুষের একটা জীবন পার হয়ে যায়। কিন্তু সেই চ্যাট ভাবছেন, স্যার হয়তো আমার প্রতি একটু বেশিই রাগছেন।
আমরা স্কুল ছাড়লে স্বাধীন হয়ে যাই, কিন্তু এই স্বাধীনতার উপভোগ করতে পারি না। কেননা মনের অন্তরালে আমি তো তখনো সেই ছোট্ট স্কুল ড্রেস পড়ুয়া ছেলে/মেয়েই রয়ে গেছি আজও।
একটু ঘুরে দেখলাম মাঠের খেলা করা ছেলেগুলোর দিকে, একপাশে বসে থাকা টিফিন শেয়ার করা মেয়েদের দিকে। মনে হলো কলেজে উঠেও এইভাবে অনেক স্মৃতি জমিয়েছি। অনেক বন্ধু বানিয়েছি। কিন্তু স্কুল জীবন এতটা ভিন্ন কেন লাগল? ভেবে পেলাম তখনকার আর এখনকার বন্ধুত্বের মধ্যেও পার্থক্য হয়ে উঠেছে। তখন আমরা যাকে পেতাম তাকেই বন্ধু বানিয়ে ফেলতাম। কেউ কাউকে নিয়ে ভাবত না, কেউ কিছু পরোয়া করত না। আর এখন বন্ধু বানাবার আগে আমরা ভেবে দেখি বন্ধুত্বের মতো যোগ্যতা তার মাঝে আছে কিনা। আমাদের থাকা সিক্রেটগুলো তার মাঝে আমানত থাকবে কিনা, তার মাধ্যমে আমার কোনো ক্ষতি হবে কিনা। তখন আবার মনে হলো এসব ভাবাই তো লজিক্যাল। তবে মনের ভেতর থাকা এই ছোট্ট সন্দেহের বীজ আমাদের নিষ্পাপ হৃদয়টাকে কি বিষাক্ত করতে শুরু করেনি?
তারপর কাজ শেষ করতে চলে গেলাম প্রধান শিক্ষকের রুমে। মেহেরুন্নেসা ম্যাম ছোট থেকেই আমাকে খুব স্নেহ করেন। তার মতো করে মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা কখনো অর্জন করতে পারব কিনা জানি না। তবে সবসময়ই তার এই স্নেহময়ী ভালোবাসা তার শিক্ষার্থীদের প্রতি আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি আমাকে লেখিকা বলে ডাকেন। সেদিনও তাই ডাকলেন। একটু হালকা নাশতা দিলেন, একটু গল্প করলেন যেন ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। এর প্রতিফলন হলো উল্টো, আমার আরো কষ্ট হতে লাগল স্কুল ছেড়ে বাড়ি ফিরতে।
স্কুল জীবনটা আমার খুব বিশেষ ছিল না। শেষের দিকটায় চাচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি যেন স্কুল শেষ করতে পারলে বাঁচি। তবে সেদিন সেই স্কুলের এক কিনারায় বসে মনে হলো দিনগুলো যদি ফিরে পাওয়া যেত, আমি যেন এখানেই রয়ে যাই। আমরা আসলে অতীত, মানুষ, জায়গার টানে কোথাও ফিরে যাই না। আমরা আমাদের স্মৃতি শিকলে বাধা পড়ে রই। আমরা কোথাও ফিরতে চাই না, আমরা আমাদের ভালো দিনগুলোকে আরেকবার উপভোগের সুযোগ খুঁজে বেড়াই। জ্ঞান অর্জনের ভিড়ে আমরা এগুতে চাইলেও ফেঁসে যাই শুধু একটি বাঁধনে। তার নাম মায়া।
"