বসুদেব রায়, রাবি
স্মরণে ওরিয়েন্টেশন
১ নভেম্বর ২০২২, দিনটি যতদূর মনে পড়ে বুধবার ছিল। রাতে হালকা বৃষ্টি হয়েছে তাই প্রভাতের আকাশে ধূসর রং লেগেই আছে। এখনো টিন সিটের অগোছালো গুদামের ন্যায় ছাত্রাবাসকে ডিঙিয়ে যাওয়া বড় শীর্ণ আকৃতির নারিকেলগাছটির আধাপাকা নিংড়ে যাওয়া পাতাটি গত রাতের কথা বলছে। তাই আবহাওয়া আজ ভারী ঠান্ডা। তবুও এই সাতসকালে স্নান করা সত্ত্বেও মনের চঞ্চলতায় শরীরে উষ্ণতার ওম লেগেই আছে। এরই মধ্যে আয়নার সামনে মুখ-মন্ডল খানি কয়েকবার দেখার পর রাস্তায় অভিমুখে বাহির হলাম। ওই তারিখটা ছিল আমার চলমান জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনাপর্ব। সেদিন ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছিলাম।
রাস্তা মেরামতের কোলাহল, শ্রমিকদের গায়ের গন্ধে ব্যস্ত শহরের মানুষগুলো বিরক্তির চিহ্ন ললাটে ধারণ করে এগিয়েই চলছে। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় গেটের মধ্য দিয়ে কত উচ্ছ্বাস, কত উদ্দীপনা, কত আবেগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলাম। দেখেছিলাম কত বড় বড় অট্টালিকা, সুন্দর সুন্দর স্থাপত্যের কারুকার্য, বাতাসে ভেসে আসা নির্মল গন্ধ, হাজারো শিক্ষার্থীর নানামুখী ব্যস্ততা, আলপনায় রঞ্জিত রাজপথ, কাঠবিড়ালির লেজ তেরে সতর্কতা, সাদা ও নীল রঙের বাসের সমারোহ ইত্যাদি ইত্যাদি সবকিছুই যেন চোখের চাওয়া ছিল তাই অজানা এক বিশেষ আকর্ষণে সবকিছুই টানছে। ঠিক নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগে, অনেক আগ্রহ ও সংকোচে ক্লাস রুমে প্রবেশ করেছিলাম। তখনো শিক্ষকরা ক্লাসরুমে প্রবেশ করেনি, তবে অথরিটি সেই সময়েও সাজসজ্জায় ব্যস্ত। অনেকগুলো নতুন নতুন মুখ দেখে নিজেকে আরো ভীতু মনে হচ্ছে। কেননা গায়ে গাঁয়ের ছোট ছোট কুঁড়েঘরের ভ্যাপসা বাতাসে মানুষের শ্রমের গন্ধ সে গায়ে কন্ডিশনের হাওয়ায় লাগছে। বাকশক্তি ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে ফেলেছি। এরই মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটি দলের আগমনে ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হলো।
তবে শিক্ষকরা ওরিয়েন্টেশন ক্লাস বলতে নারাজ, তারা তাদের বক্তৃতায় বারবার ফ্রেশার রিসিপশন কথা ব্যবহার করছে। আমার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে শুধু দুচোখ কাজ করছে। ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষক মূল্যবান কথা বলেছেন। কেউ ডিপার্টমেন্ট, কেউ ভার্সিটি, কেউ জীবনবিষয়ক নানা বিষয়ের ওপর মতামত দিচ্ছেন। শুধু আমার একজন শিক্ষকের একটা কথাই মনে আছে। তিনি তার বক্তৃতায় একপর্যায়ে এভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের দুটি ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে গোলাপ আর অন্যটি হচ্ছে রজনীগন্ধা। এখানে দুটি ফুল দুই ধরনের কথা বলে। সবচেয়ে ছোট, গন্ধহীন ও সুন্দর আকৃতির গোলাপ ফুলটি, যা বর্তমানে তোমরা। আর সবচেয়ে বড়, সুবাশযুক্ত ও সুন্দর আকৃতির রজনীগন্ধার ফুলটি যা ভবিষ্যতের তোমরা। অর্থাৎ এ বিশ্ববিদ্যালয় তোমাকে কিছু দেবে না বরং তোমাকে অর্জন করে নিয়ে সমাজে তার ঘ্রাণ ছড়াতে হবে। তোমাদের অদূর ভবিষ্যৎ তাই যেন হয়। সো বি কেয়ার ফুল, বি সেনসিটিভ।’
এভাবেই একটা প্রহর কেটে গেছে। আলোচনার শেষপর্যায়ে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার বললেন, ‘শোনো শিক্ষার্থীরা, যেহেতু আমাদের ডিপার্টমেন্ট ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট, সেহেতু আমরা খাওয়ার পর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি পরিদর্শন করব।’ ঠিক স্যারের কথামতো আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি অনেকটা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পরিদর্শন করলাম। এত বড় লাইব্রেরি এই প্রথম দেখলাম! রিডিং রুম, সার্কুলার সেকশন, পেপার রুম, ক্যাটালগ কার্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন কিছুটা জড়তা কেটে গেছে। অনেককে নিজের আপন ভাবা শুরু করেছি। আর হ্যাঁ, এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এসে ফটোসেশন হবে না, তা কি আর হয়? এর মধ্যেই কয়েক তরফা স্মার্টফোনে কয়েক রকমের ফটোসেশন হয়ে গেল।
এখন সবাই সবাইকে নিয়ে আলাপচারিতায় এক প্রকার ব্যস্ত, ঠিক তখনই আমার অনুসন্ধানী চোখ একটা আত্মার দিকে পড়ল। না না আত্মা নয়, চোখে ভেসে উঠল ইটপাথরের খোদাইকৃত সোনালি অক্ষরের একটা নামের ওপর স্যার হাসান আজিজুল হক।
"