মুরাদ হোসেন, হাবিপ্রবি

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বিশ্ব ওজোন বা ওজোনস্তর রক্ষা দিবস

ওজোন স্তরের ক্ষয় ও তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরিতে প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস পালন করা হয়। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্যগুলো ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত করার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোনস্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়। এ দিনটিই পালিত হয় বিশ্ব ওজোন দিবস বা আন্তর্জাতিক ওজোনস্তর রক্ষা দিবস হিসাবে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে মন্ট্রিল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে।

ওজোন ও ওজোনস্তর : তিনটি অক্সিজেন পরমাণু যুক্ত হয়ে ওজন অণু তৈরি করে। ওজোন স্তর (Ozone layer) হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের একটি স্তর যেখানে তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় ওজোন গ্যাস থাকে। এই স্তর থাকে প্রধানত স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের নিচের অংশে, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে কমবেশি ২০-৩০ কিমি উপরে অবস্থিত। বায়ুমণ্ডলে ওজোনের প্রায় ৯০ শতাংশ স্ট্রাটোস্ফিয়ারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফরাসী পদার্থবিদ চার্লস ফ্যব্রি এবং হেনরি বুইসন ১৯১৩ সালে ওজোন স্তর আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ আবহাওয়াবিদ জি এম বি ডবসন ওজোনস্তর নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে তিনি ওজোন পর্যবেক্ষণ স্টেশনসমূহের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন।

ওজন গ্যাসের ঘনত্ব মাপা হয় DU (ডবসন ইউনিট)-এ। বিজ্ঞানী ডবসন আবিষ্কৃত স্পেক্ট্রোফটোমেটের সাহায্যে এই ঘনত্ব পরিমাপ করা হয়। নিরক্ষীয় গ্যাসের ওপর ওজন গ্যাসের ঘনত্ব ১৫০ DU, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ওপর ৩৫০ DU, মেরু ও উপমেয় অঞ্চলের ওপর ৪৫০ DU।

ওজোনস্তরের গুরুত্ব : ওজন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনিরশ্মির অধিকাংশ শোষণ করে পৃথিবীর জীবজগতকে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। ওজন স্তরের কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ওজোনস্তরে ওজোনের ঘনত্ব খুবই কম হলেও জীবনের জন্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকর অতিবেগুনিরশ্মি এটি শোষণ করে নেয়। ওজোনস্তর সূর্যের ক্ষতিকর মধ্যমমাত্রার (তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে) শতকরা ৯৭-৯৯ অংশই শোষণ করে নেয়, যা কি না ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থানরত উদ্ভাসিত জীবনসমূহের সমূহ ক্ষতি করতে সক্ষম। মধ্যম তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে সূর্যের এই অতিবেগুনিরশ্মি মানবদেহের ত্বক এমনকি হাড়ের ক্যানসারসহ অন্যান্য মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টিতে সমর্থ। এই ক্ষতিকর রশ্মি পৃথিবীর জীবজগতের সব প্রাণের প্রতি তীব্র হুমকিস্বরূপ। বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর প্রতিনিয়তই এই মারাত্মক ক্ষতিকর অতিবেগুনিরশ্নিগুলো প্রতিহত করে পৃথিবীর প্রাণিকুলকে রক্ষা করছে।

ওজোনস্তরের বিনাশের কারণ : বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী ১৯৭০ সালের পর থেকে স্ট্রাটোস্ফিয়ার এর মোট ওজনের প্রায় ৪ শতাংশ ধ্বংস হয়েছে। উভয় মেরুর দিকে ধ্বংসের মাত্রা বেশি। অগ্ন্যুৎপাত, বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক ঘটনায় ওজোনস্তরের কিছুটা নষ্ট হয়। ওজোনস্তরের ক্ষয় অনেক বছর ধরেই উদ্বেগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক দশক ধরে ওজোন স্তর রক্ষায় স্বাক্ষরিত হয়েছে বহু চুক্তি, জারি হয়েছে নানা প্রোটোকল ও নিষেধাজ্ঞা। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছিলেন, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ওপরের ওজোনস্তর এতই পাতলা হয়েছে যে এতে একটি গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। পরে, গবেষণায় দেখা যায় যে এই গর্তের জন্য দায়ী রাসায়নিক পদার্থ- ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি)। সিএফসি হলো এক ধরনের অদাহ্য রাসায়নিক পদার্থ যেটি কার্বন, ক্লোরিন এবং ফ্লোরিনের যৌগ। এই যৌগটি অ্যারোসল স্প্রে, ফোম, প্যাকেজিং এবং রেফ্রিজারেটরে ব্যবহার করা হতো। সিএফসির কারণেই মূলত ওজোনস্তরের ক্ষতি হয়।

অতিবেগুনিরশ্মির সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া : অতিবেগুনিরশ্মির প্রভাবে ওজন অণু ভেঙে অক্সিজেন অণু ও পরমাণু উৎপন্ন করে। সূর্য রশ্মির পরিমাণ বৃদ্ধি- প্রতি ১০ থেকে ১৫ বছর অন্তর সূর্যরশ্মির পরিমাণ বাড়ে। সূর্য থেকে আগত ক্ষুদ্র তরঙ্গ বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন, নাইট্রাস অক্সাইডে পরিণত হয়। নাইট্রাস অক্সাইড রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাহায্যে ওজনস্তর রক্ষা করে।

ওজোনস্তরের ক্ষয়রোধে মন্ট্রিল প্রটোকল : যেসব পদার্থ ওজোনস্তরের ক্ষয় করে, সেসবের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমিয়ে একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিল প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। ২০০০ সাল থেকে এই গর্ত ছোট হতে শুরু করে। সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৬৬ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ সেরে যাবে এই গর্ত। প্রটোকল স্বাক্ষরিত হওয়ার ৩০ বছর পরে ওজোনস্তর ক্ষয়ের সমাপ্তি লক্ষ্য করা গেছে। তবে ওজোন ক্ষয়ের জন্য দায়ী গ্যাসগুলোর প্রকৃতির কারণে, এগুলোর রাসায়নিক প্রভাব আরো ৫০ থেকে ১০০ বছর অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হয়। সম্প্রতি জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সংস্থাগুলোর যৌথভাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন এ নিয়ে মানুষের উদ্বেগ অনেকটা কমিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধীরে-ধীরে সেরে উঠছে ওজোনস্তর।

পুরোপুরি সেরে উঠতে লাগবে আর মাত্র চার দশক। মন্ট্রিল প্রোটোকলের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা পদার্থের ৯৯ শতাংশ এখন আর বায়ুমণ্ডলে নির্গমন করা হচ্ছে না। এ কারণেই সময়ের সঙ্গে ওজোনস্তরের গর্তের দ্রুত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, মন্ট্রিল প্রটোকলনীতি দেশগুলো মেনে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। ওজোনস্তরের গর্ত কমে এলে এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধেও সাহায্য করবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close