এমপক্স নিয়ে যা জানালেন বাকৃবি অধ্যাপক
বিশ্বজুড়ে মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স নিয়ে উদ্বেগের মাঝেই এটি নিয়ে বিশ্ব জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গত ১৪ আগস্ট জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস এ ঘোষণা দেন। এমপক্স ভাইরাস ত্বক, থুথু, লালা, নাকের পানি ও যৌনাঙ্গের শ্লৈষ্মিক পৃষ্ঠের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। অর্থাৎ কথা বলা, কাশি বা হাঁচির মাধ্যমেও এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে এমপক্সও করোনা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ডব্লিউএইচওর বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা জারি করার সময়েই এই এমপক্সের গঠন, কারণ, ঝুঁকি, আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে উপসর্গ, এমপক্স প্রতিরোধে করণীয়, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ও অণুজীব বিজ্ঞানী ড. মো. বাহানুর রহমান। এমপক্স সম্পর্কে ড. বাহানুরের দেওয়া বিস্তারিত ধারণা নিয়ে লিখেছেন বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থী মো. আশিকুজ্জামান
এমপক্সের গঠন : এমপক্স রোগটি মাঙ্কিপক্স ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি হয়, যা পক্সভিরিডি পরিবারের অর্থোপক্সভাইরাস গোত্রের একটি ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ ভাইরাস এবং ক্লেড ১ ও ক্লেড ২- এই দুটি ধরন রয়েছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে এটি ডিম্বাকার ইটের আকৃতি প্রদর্শন করে।
এমপক্সের কারণ : মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। এমপক্স ভাইরাস ত্বকের ক্ষত, থুথু, লালা, নাকের পানি ও যৌনাঙ্গের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। এমনকি কথা বলা, কাশি বা হাঁচির মাধ্যমেও এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির জামাকাপড়, কম্বল, তোয়ালে, খাবারের পাত্র ব্যবহার করলেও ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন ছোট প্রাণী যেমন ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ সংক্রমিত হলে তাদের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে পশুতে ও এমনকি মানুষেও ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে।
ঝুঁকি : এমপক্স রোগটির উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে শিশু, গর্ভবতী নারী, বয়স্কসহ দুর্বল রোগপ্রতিরোধ সম্পন্ন ব্যক্তিরা।
এমপক্সের আক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় :
এমপক্স রোগটির আক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে নিচের নির্দেশনাগুলো দিয়েছেন।
১. এমপক্সের বিস্তার রোধ করার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রযোজনে বাড়িতে বা হাসপাতালে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা উচিত।
২. আক্রান্ত প্রাণী যেমন ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা। সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে বারবার হাত ধোয়া। বিশেষ করে এমপক্স আক্রান্ত ক্ষতস্থান স্পর্শ করার আগে এবং পরে।
৩. ক্ষত ঢেকে রাখা এবং মাস্ক ব্যবহার করা।
৪. আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক শুষ্ক রাখা।
৫. মুখের মধ্যে ঘা হলে নোনা জল দিয়ে ধোয়া।
৬. শরীরের ঘা হলে সিটজ বাথ, বেকিং সোডা বা ইপসম সল্ট দিয়ে উষ্ণ স্নান করা।
৭. যৌন মিলনের সময় কনডম ব্যবহার করা এমপক্স হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
৮. ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খেতে হবে।
এমপক্স রোগ নির্ণয় : গবেষণাগারে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) দ্বারা এমপক্সের ভাইরাল ডিএনএ নমুনা থেকে শনাক্ত করা হয়। নমুনা হিসেবে সরাসরি ক্ষতস্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ক্ষত না থাকলে গলা ও মলদ্বার থেকে নমুনা সংগ্রহ করা যেতে পারে। সাধারণত এমপক্সের আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয় না। আবার অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণ পদ্ধতিগুলোও তেমন কার্যকর নয়।
চিকিৎসা : এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে চার দিনের মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত, তবে কোনো লক্ষণ দেখা না দিলে ১৪ দিনের মধ্যে ভ্যাকসিন দিতে হবে। বেশ কিছু অ্যান্টিভাইরাল যেমন গুটি বসন্তের চিকিৎসায় ব্যবহৃত টেকোভিরিম্যাট এমপক্সের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও কানাডা জুড়ে ‘এমভিএ-বিএন’ নামে এমপক্সের শুধু একটি ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়েছে। ‘এমভিএ-বিএন’ সাধারণত ২৮ দিনের ব্যবধানে দুটি মাত্রায় দেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনে আরো ৩টি ভ্যাকসিন রয়েছে। এগুলো হলো জাপানের এলসি-১৬, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার এসিএএমণ্ড২০০০ এবং রাশিয়ার অর্থোপক্সভ্যাক। এগুলোর সবই মূলত প্রস্তুত করা হয়েছিল গুটিবসন্ত ও অর্থোপক্স গোত্রের অন্যান্য ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে। তবে এককভাবে এমপক্সের ভ্যাকসিন এখনো গবেষণাধীন। এ ছাড়া ‘বিএনটি-১৬৬’ বিশেষভাবে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়, যা কোভিড-১৯-এর জন্য তৈরি ভ্যাকসিনের মতো একটি এমআরএনএ ভ্যাকসিন।
বাংলাদেশে এমপক্সের ঝুঁকি সম্পর্কে অধ্যাপক বলেন, ২০২২ সালে এমপক্সের প্রাদুর্ভাব খুবই দ্রুতই ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর কারণ হিসেবে যৌনকার্যকালাপকে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া ওই বছর সুদান প্রজাতন্ত্রের শরণার্থীশিবিরগুলোতেও এমপক্সের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি শনাক্ত হয়নি। তবে এমপক্স সংক্রমিত দেশগুলো থেকে আগত প্রবাসী ও ভ্রমণকারীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে। এমপক্স আক্রান্ত দেশগুলো থেকে কেউ এ দেশে এলে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজনে তাদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। কোভিড-১৯ মহামারির মতো মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাব ব্যাপক শঙ্কা সৃষ্টি করেছে, তবে এটি প্রতিরোধ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ।
"