বাকসুর পুরোনো ইঞ্জিন চালু করতে চান শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা আবারও তাদের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (বাকসু) নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে বাকৃবিতে বাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর প্রায় ২৬ বছর পার হলেও আর কখনো এই নির্বাচন হয়নি। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, বাকসু নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র চর্চা, নেতৃত্ব বিকাশ এবং ছাত্র-শিক্ষক সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। বাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন তানিউল করিম জীম
বাকৃবিতে ছাত্র সংসদ : প্রতিকূলতা এবং সম্ভাবনা
বাকসু অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, এক বছরমেয়াদি একটি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ থাকবে, যা ১৫ জন সদস্য নিয়ে কার্য পরিচালনা করবে। এই সংসদে ছাত্রদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ছাত্রদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকবে। তারা ছাত্রদের দাবিগুলো প্রশাসনের সামনে তুলে ধরবে এবং প্রশাসনও তাদের সঙ্গে সমন্বয় করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করবে। অর্থাৎ এই সংসদ হবে ছাত্র এবং প্রশাসনের মধ্যকার যোগসূত্র।
এত দিন শিক্ষক সমিতির নির্বাচন যথাযথভাবে হলেও, হয়নি বাকসু নির্বাচন। কেন হয়নি? তা কমবেশি আমরা সবাই বুঝতে পারতাম। সংশ্লিষ্টদের অনিচ্ছা, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ অথবা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার অনৈতিক আকাঙ্ক্ষা যা-ই হোক না কেন, তাদের সুপ্ত বাসনা যে ছাত্রদের নিজেদের দাস বানিয়ে তাদের সার্বিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা, সে কথা একদম অস্বীকার করা যায় না। তাই, এই মুহূর্তে ছাত্রদের অধিকার পুনঃস্থাপনের জন্য যথাযথ ছাত্র সংসদ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা বরাবরই তালমাতাল। ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্র সংগঠনগুলো নিজ নিজ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস প্রতিনিধি থেকে ছাত্র সমিতিগুলোতেও নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে। ফলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদগুলোর একই দুরবস্থা। পড়াশোনা এবং গবেষণার পরিবেশে বাধা সৃষ্টি করেছে। সাধারণ ছাত্ররা নানাভাবে বিপর্যস্ত হতে হতে তাদের আচরণে রাজনীতির প্রতি নির্লিপ্ততা স্পষ্ট হয়েছে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছাটি চাপা পড়ে যাওয়ায় সব জায়গায় যোগ্য নেতৃত্বের শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। অন্যথা যতবারই প্রশ্ন উঠেছে ‘বিকল্প কে?’ এই প্রশ্নে আমরা এত কাবু হতাম না।
এই মুহূর্তে বাকৃবি ক্যাম্পাসে বাকসু পুনরুজ্জীবিতকরণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এত দিন ধরে ক্যাম্পাসে চলমান অসুস্থ ছাত্র রাজনীতির ট্রেন্ডকে পাশে সরিয়ে নতুন উদ্যমে ছাত্র সংসদভিত্তিক গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি পূর্বের দল-মত নির্বিশেষে এমন ছাত্রদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া, যাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো প্রকার অভিযোগ ওঠেনি। এদের মধ্য থেকেই পরে ছাত্ররা তাদের পছন্দসই প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। এতে সবারই গণতান্ত্রিক অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে।
মৃন্ময়ী পাল
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বাকসু নির্বাচন হলে একক আধিপত্য থাকবে না
সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, যা-ই বলি না কেন, এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর অধিকার এবং যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফরম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র সংসদ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্রাণের সংগঠন হিসেবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদও এর ব্যতিক্রম নয়।
বাকসু নির্বাচনের অনুপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি এবং শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমরা দেখেছি, যখন কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি, তখন ছাত্ররাজনীতি দলকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। কিছু নির্দিষ্ট দলীয় নেতা ও উপনেতা হয়ে উঠেছে একচ্ছত্র প্রভাবশালী এবং দ্ব্যর্থহীন অভিভাবক, যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো উপেক্ষিত হয়েছে।
এ ছাড়া, প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন ও আধিপত্যবাদের জন্ম দিয়েছে। এর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে আবাসিক হলগুলোতে। শিক্ষার্থীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিছিলে নিয়ে যাওয়া, জোরপূর্বক প্র্যাকটিক্যাল নোটবুক লেখানো এবং সন্ধ্যার পর গেস্টরুম নামক টর্চার সেলে আদব শেখানোর নামে অকথ্য ভাষায় গালি ও শারীরিক নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অসহায় শিক্ষার্থীরা এসব অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে।
অন্যপক্ষে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের শিক্ষকদের আধিপত্য এবং মেরূকরণ শিক্ষানীতিকে ভারসাম্যহীন এবং সময়ের সঙ্গে বেমানান করে তুলেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় ক্ষমতাসীন দল সমর্থনকারী শিক্ষকরা আসীন থাকায় এই সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল।
এই প্রেক্ষাপটে, ছাত্ররা রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক দুই ভাগে বিভাজিত হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক অংশটি স্বাভাবিকভাবেই অরাজনৈতিক অংশের ওপর আধিপত্য কায়েম করতে চায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাকসু নির্বাচন হলে কেউ এককভাবে আধিপত্য কায়েম করতে পারবে না। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে তাদের যৌক্তিক দাবি উপস্থাপন করতে পারবে। সুতরাং, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অবিলম্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি সুষ্ঠু বাকসু নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।
আল সাউদ সৌহার্দ্য
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
দ্রুত বাকসু নির্বাচন চাই
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সংক্ষেপে বাকসু নামে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সৎ, মেধাবী এবং দেশপ্রেমিক ছাত্র নেতৃত্ব তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে বাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
সব মিলে বলতে গেলে ছাত্র সংসদ প্রয়োজন ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আদায়ে জন্য। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার পরিবেশ ঠিক রেখে শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের মধ্যে একটা মডেলে পরিণত করা যাবে বলে মনে করি।
এখানে কোনো লেজুরভিত্তিক কর্মকাণ্ড থাকবে না। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো সৎ, নীতিবান এবং আদর্শবান একজন প্রতিনিধি বাছাই করতে পারবে। প্রতিনিধি এমন কেউ হবেন, যার গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছে আছে। যে শিক্ষার্থীদের তার নিজের ভাই-বোনের মতো দেখবে। পরিবারের বড় ছেলের মতো সব ছাত্রছাত্রীদের আগলে রাখবে।
সে একই সঙ্গে চেষ্টা করবে শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীর একটি ভালোবাসার, সম্মানের সম্পর্ক তৈরি করতে। সব মিলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে একটি প্রশান্তির জায়গা।
আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাকসু এবং হল সংসদের নির্বাচন দেবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করবেন।
মো. মারুফ বিল্লাহ
শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
"