তানভীর হাসান রবিন, ইবি
বৈষম্যহীন সমাজ ছিল চব্বিশের শহীদ সিফাতের স্বপ্ন
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের এই গল্পে চরিত্রের নাম সিফাত হোসেন। রাজনীতির সঙ্গে কোনো লেনদেন ছিল না সিফাতের। স্লোগানমুখর উত্তাল ক্ষণে কিংবা প্রতিরোধের দিনে, সে সারথি হয়েছে সাহসের বাতিঘর হয়ে। চলনে-বলনে ছিল অত্যন্ত বাকপটু ও চঞ্চল গোছের। কিন্তু শুভ্র-স্বচ্ছ-সরল মনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত ছিল সিফাত।
এক-দুই-তিন করতে করতে একই সঙ্গে মাধ্যমিকের গন্ডি পার হয়েই পাঠ চুকিয়ে ফেলে সিফাত। কিন্তু স্বপ্ন ছিল আকাশচুম্বী। সেই আকাশচুম্বী স্বপ্নের কাঁধে ভর করেই পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব। চঞ্চল সিফাতের সেখানে বছর তিনের অধিক থাকা হলো না। স্বপ্ন কাঁধেই ফেরেন স্বদেশের মাটিতে। আকাশচুম্বী স্বপ্ন দিনে দিনে ভারী হতে থাকে। এবার গন্তব্য ঠিক করলেন ইউরোপের দেশ ইতালি। ইউরোপ পারি দেওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়াই চলমান ছিল।
ক্যালেন্ডারে ২৯ জুন। আমার চাচা আমাদের রেখে পাড়ি জমান অনন্তের পথে। আমি তখন রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছিলাম। ওইদিনই বাড়িতে চলে আসি। কিছুদিন বাড়িতে কাটানোর পর ৮ জুলাই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার এক দিন আগের রাতে সিফাতের সঙ্গে দেখা। সে কি অভিমান! এত দিন হয়ে গেল বাড়িতে আসলাম অথচ এক দিনও ওর সঙ্গে দেখা করলাম না, চায়ের আড্ডায় গল্প জমালাম না।
খুব অনুনয়-বিনয় করে সেবার সেই পরিস্থিতি সামালের চেষ্টা। এরই মধ্যে ক্যাম্পাসে চলে যাচ্ছি শুনে সে কি চিন্তা ওর, দেশের পরিস্থিতি ভালো না, সাবধানে থাকবি, আঙ্কেল-আন্টির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবি। শত উপদেশমূলক ও সতর্কতামূলক বাণী শোনাতে শোনাতে বাড়ি পর্যন্ত এলো। সকালে আর দেখা হচ্ছে না তাই এখানেই বিদায় দিয়ে গেল। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সেদিন বুঝতে পারলাম না, এই দেখাই শেষ দেখা, এই বিদায়ই চির বিদায়। পরদিন সকালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি। এদিকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ উত্তাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে ১৫ জুলাই ঢাকায় চলে যায় সিফাত।
১৬ জুলাই জাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়। স্বৈরতন্ত্রের দুঃশাসনকে ভাঙতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী, ইতিহাসের বাঁক-মোহনার অগ্রনায়ক আবু সাঈদের সিনা টান করা বুক পুলিশ নামক ঘাতকের নারকীয় বুলেটের আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে যায়। কোটা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে নাম লেখান আবু সাঈদ।
এরপরই সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। ছাত্রসমাজ থেকে আপামর জনতা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে স্বৈরতন্ত্রের শিকল ছিঁড়তে দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘদিনের জমানো পুঞ্জীভূত ক্ষোভের এমন জনরোষ স্ফুলিঙ্গের মতো বিস্ফোরণে রূপ নেয়, তৈরি হয় গণজোয়ার, জনস্রোত।
পড়াশোনার পর্ব চুকিয়ে ফেলা সিফাতের ভবিষ্যতে চাকরির কোনো ইচ্ছা বা পরিকল্পনাই ছিল না। কিন্তু তবুও আবু সাঈদদের রক্তের ঋণ শোধ করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সিফাতও ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি কোটা সংস্কারের পক্ষে, রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে।
ক্যালেন্ডারে ২০ জুলাই ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১টা। মিরপুর-১০ নম্বরে কারফিউ চলাকালীন নির্মাণাধীন একটি ভবনের চতুর্থতলায় অবস্থান করছিল সিফাত, সঙ্গে ছিল তার অপর আর এক বন্ধু সিয়াম ও সিফাতের বাবা কামাল হাওলাদার। চতুর্থতলা থেকে নিচে সিফাত দেখতে পায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একটা মিছিল বের হয়। সাঁজোয়া যানে ওত পেতে থাকা ঘাতক পুলিশ সেই শিক্ষার্থীদের মিছিলে পাক-হানাদার বাহিনীর মতো অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে। নারকীয় গণহত্যার সম্পূর্ণ ভিডিও সিফাত তার মোবাইলে ধারণ করে। নিচে থাকা ঘাতক পুলিশ সিফাতকে তাদের নারকীয় গুলিবর্ষণের দৃশ্যধারণ করতে দেখে ফেললে সিফাত ও তার বন্ধু সিয়ামকে লক্ষ্য করে নিচ থেকেই গুলি করতে শুরু করে তারা। ঘাতকের একটি বুলেট এসে সিফাতের মাথা ভেদ করে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। অন্য আরেকটি বুলেট এসে সিফাতের বন্ধু সিয়ামের চোখের মণি ভেদ করে মাথার মধ্যে ঢুকে যায়।
আব্বু বলে শেষ চিৎকার দিয়ে ওঠে সিফাত, মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে। অপর রুম থেকে ওর বাবা এসে দেখে, সন্তানের নিথর দেহ পড়ে আছে। পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সিফাতের মস্তিষ্ক। মাথা গড়িয়ে ফ্লোর ভেসে যাওয়া তাজা রক্তের বন্যা যেন চিৎকার করে বলছিল...
‘নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান,
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’
তীব্র আন্দোলনের মধ্যে আমার বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল বন্ধ ঘোষণা করায় ক্যাম্পাসের পাশেই এক বন্ধুর বাসায় অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলাম। নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় মৃত্যুর খবর আমাকে পৌঁছানো হয় নাই। তবুও রাতেই সিফাতের শহীদ হওয়ার খবর শুনতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে আমি এক প্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। বেশিক্ষণ আর বাকরুদ্ধ থাকতে না পেরে হঠাৎ মনে পড়ে হারানো সিফাতের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। যখন আমার স্মৃতির মানস্পটে ভেসে উঠছিল, তখনই যেন হাউমাউ চিৎকার করে উঠলাম। ফ্ল্যাটসংলগ্ন অপরিচিত এক আন্টি এসে খাবার দিয়ে গেলেন আমাকে। এ যেন সেই মুক্তিযুদ্ধে গ্রামবাংলার মায়েদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আতিথেয়তার চিত্র, আমার চোখের সামনে বাস্তবিক সত্য হয়ে ফুঁটে উঠল।
পরদিন ভোরে কারফিউ চলাকালীনই আমি বাড়ির উদ্দেশে বের হয়ে পড়লাম। নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে দুপুরের পর বাড়িতে এসে পৌঁছালাম। লাশের খাটিয়া বহনের সময় বুলেটের আঘাতে সিফাতের ক্ষত-বিক্ষত মস্তিষ্কের শহিদী রক্ত গড়িয়ে পড়ে, যখন সব বন্ধুর হাত-জামা রঞ্জিত হওয়ার বর্ণনা শুনছিলাম, তখন যেন আবু সাঈদ থেকে শুরু করে সব শহীদণ্ডশহীদানের রক্তেরই ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম।
ক্যালেন্ডারে ৫ আগস্ট। বহুকাঙ্ক্ষিত মুক্তিকামী ছাত্রজনতা স্বাদ পেল তাদের সেই বিজয়ের। ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থান স্বৈরাচার পতনের এপিটাফ লিখে নতুন ইতিহাসের দ্বার উন্মোচন করল।
নতুন বাংলাদেশে যার যার জায়গা থেকে প্রতিটি মানুষ নিজেকে শুদ্ধ করলে আর সভ্য হলেই শুধু আবু সাঈদের সিনা টান করা বুক কিংবা মুগ্ধর তৃষ্ণার্থ কণ্ঠ অথবা সিফাতের আত্মাহুতি দান সার্থকতা পাবে।
সিফাতদের স্বপ্নগুলো বেঁচে থাক অযুত-লক্ষ-নিযুত কোটি বছর।
সাঈদ-সিফাত-মুগ্ধদের আত্মাহুতি দানে শোকের স্রোতে অমর হয়ে রবে ইতিহাস। রাষ্ট্র সংস্কারে শহীদ হওয়া বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতিতে নিবেদিত বিনম্র শ্রদ্ধা।
"