তারুণ্যের দৃষ্টিতে আগামীর বাংলাদেশ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং সক্রিয় সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একাংশের চোখে আগামীর বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান? কেমন দেখতে চান আগামীর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সংস্কৃতির সংস্কার? তাই তুলে ধরেছেন চবির রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের মো. মারুফ মজুমদার
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ চাই
এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সবার অধিকার সুনিশ্চিত করা। বাংলাদেশের সৃষ্ট সংবিধান মতে, সুন্দর আগামীর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গড়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করি। কিছু কুচক্রী মহল, অসাধু মানুষ, সুবিধাভোগী শ্রেণি স্বীয় ফায়দার জন্য লঘু জনগোষ্ঠীর ওপর যে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে তার সুষ্ঠু বিচারের প্রত্যাশা করি। সমূলে সংস্কার হোক, স্বাধীন স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ একান্তই কাম্য। সবিশেষ, তারুণ্যের এই জয়গান যেন না ভুলি সবাই। একটি তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশ চাই। এই আন্দোলনে শহীদ সব ভাইয়ের প্রতি রইল অসীম কৃতজ্ঞতা এবং তাদের পরিবারের বন্দোবস্ত করার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
ইয়াসিন আরেফিন চৌধুরী
সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
অন্যায়কে রুখে দিন
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিপ্লবের একটি নতুন ধাপে আমরা পদার্পণ করেছি। তবে বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটেছে বলে আমি মনে করি না। বিপ্লবের এই ধাপে আমরা আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি বলেই আমার বিশ্বাস। তাই সচেতন নাগরিকের কাছে আমার আহ্বান থাকবে; আপনারা যে প্রকৃত মানবসেবায় নিয়োজিত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, বুদ্ধিমান তাকেই নেতা হিসেবে গ্রহণ করবেন। আপনারা যেখানেই অন্যায় দেখবেন সেখানেই নিজ অবস্থান থেকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। আপনার এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় আপনিই সচেতন হবেন। আপনার এলাকার সবার মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন বজায় রাখার জন্য আপনি নিজ উদ্যোগে কাজ করবেন। কেউ চাঁদাবাজি করার চেষ্টা করলে সংঘবদ্ধভাবে রুখে দেবেন। মনে রাখবেন, অন্যায় যত দিন থাকবে, বিপ্লবের এই ধারা তত দিন অব্যাহত থাকবে।
আব্দুল আউয়াল আলাওল
সমন্বয়ক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উচ্চশিক্ষায় কর্ণপাত করুন
দেশের প্রথম সারির একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমার মধ্যে অনেক আগ্রহ কাজ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম থেকে সেই আগ্রহকে কাজে পরিণত করার মতো কোনো সুযোগ পাইনি। আমি নিশ্চিত দেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ ও যতেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরিভাবে এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশ্বের প্রথম এক শ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকলেও আমাদের দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয় আমাদের। যার অন্যতম একটি কারণ হলো শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতা ও শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অসহযোগিতা করার মানসিকতা। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষা ও গুণগত মানদ- অনুযায়ী যাতে বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, তাই গবেষণা খাতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ বরাদ্দ ও গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করাটা জরুরি। সেই সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত অ্যাকাডেমিক বিষয়গুলোয় যাতে হাতেকলমে গবেষণার সুযোগ থাকে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যমান ‘টিচিং অ্যাসিসট্যান্টশিপ প্রোগ্রাম’ সম্পর্কে জানি, যেটি আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য এই ধরনের অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে তাদের গবেষণায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও অ্যাকাডেমিক বিষয়বস্তুর সর্বোচ্চ অনুশীলন সম্ভব বলে মনে করি। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দের ব্যবস্থা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, কারণ সর্বোপরি গবেষণা কার্যক্রম দ্বারা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা যায়। দেশের শক্ত মেরুদণ্ড গঠনে ও গুণগত দিক ও বৈশ্বিক ইনডেক্স অনুযায়ী অবস্থান নিশ্চিত করতে গবেষণা খাতে সরকারি ও বেসরকারি বরাদ্দের বিকল্প নেই।
মাফরুহা চৌধুরী
শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মেধাবীদের কাজে লাগাতে হবে
বাংলাদেশে মেধা পাচার বর্তমানে একটি জাতীয় সমস্যা। দেশের মেধাবী তরুণরা উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের স্বপ্নে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ শিক্ষার্থী, যা ক্রমবর্ধমান। সাধারণত এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশই দেশে ফিরে আসেন না। এর ফলে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম স্থবির হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। মেধা পাচারের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দেশে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, অনুন্নত বেতন-ভাতা ও কাজের পরিবেশ, আন্তর্জাতিকমানের উচ্চশিক্ষার সুযোগ না থাকা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। মেধা পাচার দেশের অর্থনীতি, সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ছাড়া মেধা পাচারের ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় মেধাবী মানবসম্পদ কমে যাওয়ায় গবেষণা ও উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেধা পাচার রোধে দেশের অভ্যন্তরেই মেধাবীদের জন্য আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। এর জন্য শিক্ষার মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেতন-ভাতা ও কাজের পরিবেশ উন্নত করা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ও সুযোগ সৃষ্টি করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। মেধা পাচার একটি জটিল সমস্যা, যা হুট করেই সমাধান করা সম্ভব নয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সরকার, বেসরকারি খাত ও সমাজের সর্বস্তরের সহযোগিতা। দেশের মেধাবীদের দেশে রেখে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে।
নিলয় অপু
শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আইনের শাসন
তারুণ্যের নেতৃত্বে মহা এক বিপ্লব উত্তর আমাদের দেশে নানা সম্ভাবনা হাতছানি দিলেও নানামুখী অরাজকতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য সবার আগে আমাদের যা করতে হবে তা হলো দেশের আইনশৃঙ্খলা পুনর্গঠন ও বিচার বিভাগকে সক্রিয়করণ। দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের নজিরবিহীন অবৈধ হস্তক্ষেপ আমাদের বিচার বিভাগকে কলুষিত করার পাশাপাশি মানুষ এতে ভয়ানকভাবে আস্থা হারিয়েছে। বিচার বিভাগ হলো সংবিধানের রক্ষক, কাজেই একটা গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গঠনে এবং সুশাসন নিশ্চিতে বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। বিচার বিভাগের সংস্কারে সবার আগে সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ ও কার্যত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অনুচ্ছেদ ৯৬ এর রিভিউ আদেশ যা-ই আসুক বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে রাখতে হবে। পাশাপাশি হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণের স্বার্থে অনুচ্ছেদ ১০০ মোতাবেক দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাইকোর্টের আসনবিন্যাস করা যেতে পারে, তাহলে রিটসহ নানা আপিলের দ্রুত ও সুষ্ঠু শুনানি সম্পন্ন করা যাবে। আরেকটি বিষয়ে কড়া নজর দিতে হবে, তা হলো মামলার জট নিরসন। আমাদের কোর্টগুলোয় প্রতি বিচারকের ওপর অসাধ্যতুল্য মামলা পড়ে আছে, যা দিনে দিনে বহু গুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এটিই সুবিচারের অন্তরায় হয়ে উঠছে। এ সমস্যা সমাধানে দেশের অধস্তন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে কড়া নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। সবশেষে আমাদের পুলিশি তদন্ত ও অনুসন্ধানে সচ্ছতা আনয়নে পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। পিআরবি এবং সিআরপিসি মেনে পুলিশি কার্যে যথা জবাবদিহি ও সচ্ছতা এলে তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারের পথ সুগম করবে বলে আমার বিশ্বাস।
বায়েজিদ বোস্তামী
চতুর্থ বর্ষ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান
ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায় বলার সৎ সাহস ও সুযোগ মানুষের জন্মগত ও রাজনৈতিক অধিকার। যেকোনো রাজনৈতিক দলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলুন। সেটা এখন থেকেই যদি না হয়, অদূর ভবিষ্যতে আপনি কথা বলতে ভয় পাবেন, আপনার বিরুদ্ধে যে অন্যায় হবে তা বলতে ভয় পাবেন তখন রাজনৈতিক দলগুলো আপনার ভয়ের কারণ হবে, তখন তারা আবার দলীয়ভাবে ডিক্টেটরশিপ হয়ে উঠবে। তাদের জুলুম সবাইকে ভোগ করতে হবে। তাদের থেকে মুক্তি পেতে আবারও সাঈদ, ওয়াসিম, ফরহাদ, হৃদয় তুরুয়া, মুগ্ধদের মতো অনেককে জীবন দিতে হবে। সুতরাং, স্বাধীন এই বাংলায় মুক্ত বিহঙ্গের মতো ওড়ার মতোই, মুক্তভাবে কথা বলতে দিতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের আদৌ যুক্তিযুক্ত আছে কি না, তা ভাবার সময় এসেছে। মনে রাখতে, প্রাণের চেয়ে স্বাধীনতার স্বাদ কয়েক গুণ। আমরা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছি, প্রাণের জন্য প্রাণ নয়।
মোহাম্মদ এনামুল হক
শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"