নতুন করে দেশ গড়তে শিক্ষার্থীদের ভাবনা
বাংলাদেশ যেন নতুন করে স্বাধীন হলো স্বৈরাচারী শাসন থেকে। নাশকতাকারীদের কর্মকাণ্ডে পুরো দেশ যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকে নতুন করে সাজাতে শিক্ষার্থীরা কী ভাবছেন? ৫ জন মেধাবী শিক্ষার্থীর ভাবনা তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী জোবাইদুল ইসলাম
আমাদের স্বাধীনতা যেন আবার ভূলণ্ঠিত না হয়
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের দীর্ঘ ২৩ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলেও আমরা পুনরায় ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী শক্তিগুলোর কাছে পরাধীন হয়ে পড়ি। তারা বিভিন্ন সময় আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সব স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। পাশাপাশি জনগণের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পলায়নের মাধ্যমে আমরা আওয়ামী স্বেরাচারীদের কবল থেকে আমাদের অসংখ্য ভাই-বোনের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করি। তবে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। ১৯৭১-এ স্বাধীনতার পর, ১৯৯০-এ স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর আমরা পুনরায় নতুন স্বৈরাচারের অধীন হতে শুরু করি। তারা ধীরে ধীরে আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সব স্বাধীনতা হরণ করতে থাকে এবং দেশে এক অরাজক ব্যবস্থা তৈরি করে। তাই আমাদের ২৪-এর স্বাধীনতা যেন কোনোভাবেই অন্য স্বৈরাচারীর কবলে পড়ে লুণ্ঠিত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পাশাপাশি ক্যাম্পাসগুলোয় সব ধরনের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে পড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং দেশে সব ধরনের দুর্নীতি, গুম, খুন, হত্যা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অত্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে আমাদের দেশকে একটি সত্যিকারের সোনার বাংলায় রূপান্তর করা প্রতি আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।
মো. আব্দুর রহিম
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো শিক্ষাব্যবস্থা করা হোক
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। একটি দেশ সুন্দরভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বপ্রথম দরকার শিক্ষিত জনতা। কিন্তু পদত্যাগকৃত আওয়ামী লীগ সরকার এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে গেছে, যাতে নেই কোনো পরীক্ষা ব্যবস্থা, নেই কোনো উপযুক্ত শিক্ষার ছোঁয়া। যে শিক্ষা শরীফ থেকে শরীফা হতে শেখায়, যে শিক্ষা মেয়েদের নর্তকির মতো নাচাতে বাধ্য করে এই শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চাই না। এমন শিক্ষাক্রম আমাদের শিক্ষকরাও সমর্থন করেন না। জালিম সরকার চেয়েছে আমাদের মেধাশূন্য করতে। এজন্য জোর খাটিয়ে এমন ঠাট্টামূলক শিক্ষাক্রম চালু করেছে। আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা বহাল থাকলে মেরুদণ্ডহীন জাতি গড়ে উঠবে। আমাদের দেশ যেহেতু ২৪-এ এসে পুরোপুরি স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে, সেহেতু আমরা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যার দ্বারা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে। এতে দেশ ও জাতি উভয়ে উপকৃত হবে।
মো. আব্দুল ওহাব
শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীনতার পুনরুদ্ধার করতে হবে
শৈশব থেকেই মুক্তিযুদ্ধের রক্তিম ইতিহাস পড়েছি কাগজে-কলমে, বীভৎস অত্যাচার আর অপরাজেয় বীরত্বের কাহিনি শুনেছি দাদা-দাদির মুখে। কিন্তু ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ নামক শব্দের খোলসে আটকে থাকা অধিকারহীন নির্যাতিত বাংলাদেশ নিয়ে কখনোই স্বস্তি বোধ করিনি। অনেক সময় স্বাধীনতার প্রতীকগুলোকে উপহাস মনে হতো। কিন্তু আমাকে প্রতিবারই স্বস্তি দিয়েছে ছাত্র-জনতার রক্তিম ইতিহাসগুলো। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আমাকে দিয়েছে নতুন শক্তি আর উদ্যম। অবশেষে ৫ আগস্ট বা ৩৬ জুলাই ২০২৪ আমরা স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে আবারো ছাত্র-জনতার ঐক্য, শক্তি, সাহসিকতা আর ত্যাগ দেখলাম। এই দ্বিতীয় স্বাধীনতায় আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাইব যেখানে মানুষ পাবে ন্যায়বিচার, বিচার বিভাগ হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন, ছাত্ররা পাবে সৃজনশীল আর বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা, সাধারণ মানুষ ঘুষ, দুর্নীতি আর বৈষম্য থেকে মুক্ত থেকে তাদের সব অধিকার ভোগ করবে, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিক স্বাধীন ও নিরাপদভাবে বসবাস করতে পারবে। এ রকম সুন্দর-নির্মল সোনার বাংলাই আমাদের কাম্য।
মো. তাওফীকুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
জনগণের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে
একটি নতুন বাংলাদেশ চাই। যেখানে পদে পদে ঘুষের ছড়াছড়ি থাকবে না, যেখানে ফেসবুকে পোস্ট লিখেও সিকিউরিটি আইনের ভয়ে সেটাকে ডিলিট করে দিতে হবে না, যেখানে প্রতিবেশী দেশের নগ্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার অপরাধে কাউকে শিবির ট্যাগ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হবে না।
এমন একটি দেশ চাই, যেখানে হিজাব-নিকাবের কারণে কোনো নারী লাঞ্ছিত হবে না, শাঁখা-সিঁদুরের কারণেও না। যেখানে টুপি-দাড়ির কারণে কাউকে বলা হবে না জঙ্গি আর ধুতি-পাঞ্জাবি দেখে কাউকে বলা হবে না সংখ্যালঘু। এমন দেশ চাই, যেখানে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার থাকবে, কথা বলার অধিকার থাকবে, থাকবে লেখালেখির স্বাধীনতা। মানবাধিকার থাকবে সমুন্নত। যে দেশে সবাই আমরা মানুষ হয়ে একসঙ্গে বসবাস করব।
ফেরদাউস হাসান
শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রয়াস চালাতে হবে
প্রায় শ-পাঁচেক প্রাণের বিনিময়ে আমরা আমাদের দেশকে স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত করেছি। আমাদের শহীদরা শুধু যে ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্যই প্রাণ দিয়েছেন, তা আমি মনে করি না। বরং একটি বৈষম্যহীন উন্নত সমাজব্যবস্থা গড়ার জন্যই তাদের এই ত্যাগ এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘটেছে। দেশটাকে নতুন করে গড়তে হবে। দেশের প্রতিটি সেক্টর প্রায় ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। দুর্নীতি আমাদের দেশের অন্যতম একটি সমস্যা। সুষ্ঠু জবাবদিহি না থাকায় সরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে সয়লাব হয়ে আছে। তাই অন্যসব কর্মসূচির পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিতসহ দুর্নীতির বিষয়ে কঠোর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুদকের পুনর্গঠন আবশ্যক। দেশের আইনশৃঙ্খলা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলো চরম অবনতি হয়েছে। জনগণের ন্যূনতম আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়েছে তারা। এটি ফিরে পেতে পুলিশ প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে। এখনো বিদ্ধমান তাদের সব গোঁয়ার্তুমিপূর্ণ কার্যকলাপ বর্জন করে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ও সহনশীল আচরণের মাধ্যমে দ্রুত জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল-পরিবর্তনসহ, ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার ও বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। আর এর জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহায়তায় ছাত্র-জনতাকেও এগিয়ে আসতে হবে।
তাহসীন আহমেদ
শিক্ষার্থী
আরবি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"