নতুন স্বাধীনতা ঘিরে শিক্ষার্থীদের ভাবনা
৫ আগস্ট বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইতিহাসের দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছেন। গত ১ জুলাই থেকে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা প্রাথমিক বিজয় নিশ্চিত করেন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে। ছাত্র-জনতার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার আপামর জনতার তোপে গদি ছেড়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এর ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা অত্যাচার, নিপীড়ন, ধরপাকড়, গণহত্যা, গুম ও খুনের অবসান হয়। সারা বাংলার মানুষ উল্লাসে মেতে ওঠে। এই উল্লাসের বড় চিহ্ন দেখা যায় সাধারণ জনতার শহীদ মিনার, গণভবন ও মহান জাতীয় সংসদসহ দেশের সব জায়গায়। ছাত্র-জনতার এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটি ছিল স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, দেশে বাক-স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দূর ও মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য। যাই হোক, নয়া এই স্বাধীনতাকে শিক্ষার্থীরা কীভাবে দেখছেন তা তুলে ধরেছেন প্রতিদিনের সংবাদের প্রতিনিধি আবু হাসনাত তুহিন
ছাত্রদের মূল চাওয়া সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম কিন্তু আজ আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। এই স্বাধীনতা হলো বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ভোটাধিকারের স্বাধীনতা। যার মূল কারিগর ছাত্ররা। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ১৬ বছরের স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে। এই স্বাধীনতা থেকে ছাত্রদের মূল চাওয়া হলো বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, সম্প্রীতির একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে প্রশাসনিক স্বচ্ছ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করবেন। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্টের সময়ে আছে। তাই এটাকে কাজে লাগিয়ে, তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাওয়াও শিক্ষার্থীদের একটি চাওয়া। এজন্য শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের থেকে তারুণ্যের নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিতে চায়।
রুবাইয়া আক্তার
দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীনতা কখনোই স্বাধীন ছিল না
বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শুরু করতে চাই, যেখানে মেডগার এভারস বলেন, ‘স্বাধীনতা কখনোই স্বাধীন ছিল না।’ স্বাধীনতার শাব্দিক অর্থ বলতে গেলে স্বাধীনতার কোনো সীমানা টেনে দেওয়া যাবে না। ১৯৪১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট মানুষের স্বাধীনতার শাব্দিক অর্থকে চারটি বিষয়ে অপরিহার্য হিসেবে তুলে ধরেছেন-
১. বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা,
২. ধর্মের স্বাধীনতা,
৩. অভাব ও
৪. ভয় থেকে মুক্তিকে।
সুতরাং, বিপ্লব/গণবিপ্লব/অভ্যুত্থান/গণ-অভ্যুত্থান- এগুলো আমাদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নয়, শুধু স্বাধীনতায় প্রবেশের একটি দরজামাত্র। আমরা যেভাবেই কোনো শাসককে উৎখাত বা পরিবর্তন করি না কেন, উপরোক্ত বিষয়গুলো অর্জন ছাড়া স্বাধীনতার একটি সুষম কাঠামো আশা করা যায় না।
মো. হাবিবুর রহমান
আইন ও ভূমি প্রশাসন, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
শুধু রাজনৈতিক নয়, চাই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সুযোগ
বাংলাদেশের নতুন স্বাধীনতা শিক্ষার্থীরা এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। তারা এই স্বাধীনতাকে শুধু রাজনৈতিক নয় বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করছে। শিক্ষার্থীরা মনে করে, স্বাধীনতার মানে শুধু একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয় বরং প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উন্নয়ন। তারা দেশের প্রযুক্তি ও শিক্ষার উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং বিশ্বাস করে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করে দেশকে বিশ্বমানে উন্নীত করা সম্ভব। শিক্ষার্থীরা সুশাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাইছে, যেখানে বৈষম্য ও অন্যায়ের কোনো স্থান নেই। তাদের দৃষ্টিতে নতুন স্বাধীনতা মানে হলো একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞা।
মো. আবু জুবায়ের
ভর্তি-ইচ্ছুক
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, পার্বতীপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল ও কলেজ
বৈষম্যবিরোধী চেতনাকে জীবন্ত রাখতে হবে
সত্যি বলতে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি, আমাদের শহীদ ভাইয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দিয়েছে, সেই রক্তের দাম যদি আমাদের দিতে হয় তাহলে এই নয়া স্বাধীনতাকে রক্ষা করতেই হবে। আমরা বৈষম্যবিরোধী যে চেতনা নিয়ে এগিয়েছি, তাতে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ পেয়েছি। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ সব বৈষম্যও দূর করতে হবে। দেশের বড় অংশের মধ্যে যে অবিশ্বাস, উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে কাজ করতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত যেন কিছু না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি দেশপ্রেমে জনগণকে উজ্জীবিত করতে হবে। বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। তরুণদের সদা জাগ্রত থাকতে হবে। আমার বিশ্বাস এই প্রজন্ম পারবে। কারণ এরাই জেনারেশন জেড। এদের ইচ্ছাশক্তি আর কর্মদক্ষতার প্রমাণ পেয়েছি। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।
মো. জাহিদ হোসেন
লোকপ্রশাসন বিভাগ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
এ দেশ থেকে যেন আর এক টাকাও পাচার না হয়
নতুন স্বাধীনতা এসেছে শিক্ষার্থীদের হাত ধরে। তবে স্বাধীনতা পাওয়ার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। আমি একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এই নতুন দেশ দূর্নীতি মুক্ত দেখতে চাই যেন-
১. এ দেশ থেকে আর এক টাকাও পাচার না হয়।
২. এ দেশের মানুষ যেন কোথাও এক টাকাও ঘুষ না দেয়।
৩. প্রতিটি মানুষ যেন খারাপকে খারাপ আর ভালোকে ভালো বলার বাকস্বাধীনতা পায়।
৪. ২৪-এর স্বাধীনতার পর শিক্ষার্থীরা যেভাবে ট্রাফিক কন্ট্রোল, গাছ লাগানো, আবর্জনা পরিষ্কার কাজে সারা দেশে সোচ্চার হয়েছেন, এভাবে দেশের প্রতিটি মানুষকে দেশের জনশক্তি হিসেবে চায়।
৫. জনগণকে জনশক্তিতে পরিণত করার উদাহরণ শিক্ষার্থীরা তাদের কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে গেছে।
ইসরাত জাহান ইভা
আইন ও ভূমি প্রশাসন, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
"