মো. আরিফুল ইসলাম আকাশ, ঝালকাঠি সরকারি কলেজ

  ০৬ আগস্ট, ২০২৪

অতিথি পাখির দেশ সাচিলাপুরে একদিন

ব্যস্ত শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের দেয়ালের বন্দিদশা থেকে মন চায় বাইরের উন্মুক্ত দুনিয়ায় নিঃশ্বাস নিয়ে জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে। ব্যস্ততা আর মানসিক অবস্বাদে পড়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে তার শীতলতায় মনকে ফুরফুরে করতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ঝালকাঠি সনাক আয়োজন করে শীত উৎসবের। সনাক, ইয়েস ও এসিজি পরিবারের সবার সমন্বয়ে প্রায় ৮০ জনের অংশগ্রহণে শীত উৎসবের মিলনমেলা। নৌভ্রমণের মাধ্যমে অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত স্থান পরিভ্রমণ, দিনব্যাপী আকর্ষণীয় খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিল।

মাঘের জেঁকে বসা হিমশীতের জ্বলমলে রোদ্দুর গায়ে মেখে নৌভ্রমণের মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সাচিলাপুর চরে যাওয়ার তারিখ নির্ধারণ হয় ২৭ জানুয়ারি, ১৩ মাঘ শনিবার। কিন্তু বিপত্তি বাধে বৈরী আবহাওয়া। দেশ জুড়ে একটানা শৈত্যপ্রবাহ ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের কথা বিবেচনা করে শীত উৎসবটি পেছানো হয়। এটা সত্যি, আমার জন্য দারুণ সুযোগ বয়ে এনে দিয়েছিল। কারণ ২৭ তারিখ হলে আমি যেতে পারতাম না অন্য একটি ফাংশনের জন্য। আজ আর সেদিকে না যাচ্ছি। পরবর্তী তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করা হয়।

মাঘের সকালে ঝলমলে মিঠে রোদ। আকাশে হালকা কুয়াশা। ভরদুপুরেও সে রোদে তেজ নেই। বাতাসে বসন্তের গুঞ্জন। সে গুঞ্জনই বসন্তের আগমনী গান। পরন্ত মাঘের সকালে হিম হিম শীতে ঝালকাঠি শহরের স্টিমার ঘাঁট থেকে সকাল ৯টায় ট্রলারযোগে রওনা দিলাম সাচিলাপুরের উদ্দেশে। দুপাশে সবুজের সমারোহর বুকচিরে বেরিয়ে গেছে সুগন্ধা নদী। এই অপরূপ নান্দনিকতায় হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যেকোনো পাষ- পুরুষও পূজারি হতে বাধ্য। ঘণ্টাখানেক নদী পথ পাড়ি দিয়ে আমরা কাঙ্ক্ষিত চড়ে এসে পৌঁছালাম। সুগন্ধা নদীর বুক ফেরে জেগে উঠেছে বিশাল এক চর। জোয়ারের সময় পানিতে তলিয়ে থাকে ও বাটার সময় দৃশ্যমান হয়। আমরা যখন পৌঁছালাম তখন সম্ভবত জোয়ার ছিল। সবাই শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে নদীর দুপাশে অপরূপ জীববৈচিত্র্য দেখতে দেখতে যখন একটু ঝিমিয়ে পড়ল, ঠিক তখনই আমাদের ট্রলারের পাখা চরে আটকা পড়ে খুব জোরে একটা ধাক্কা লাগল। আমি আর মেহেদী ভাই (হলের বড় ভাই) দাঁড়িয়ে দুজন কথা বলতে ছিলাম, ঠিক তখনই ধাক্কা লাগল। আমি ইঞ্জিনের পাশে ছোট্ট জায়গায়টায় পড়ে গেলাম। আমার পিঠের ওপর থেকেই মেহেদী ভাইসহ কয়েকজন সামনে গিয়ে আচরে পড়ল। তবে স্বস্তির কথা হলো, কেউ ব্যথা পায়নি। ট্রলারের ড্রাইভার ভাইয়া একটা গামছা মুড়িয়ে নিজেই নেমে পড়ল। বয়স হয়তো ১৬/১৭ হবে। তবে বয়সের খাতার থেকেও দক্ষতার খাতা বেজায় ভারী। ট্রলার আবার চলা শুরু করল। নদীর একপাশে হলুদণ্ডসর্ষে ফুল যেন সদ্য বিবাহিত কুমারী মেয়ে গায়েহলুদের শাড়ি পরে অপরূপ সাজে সেজেছে।

অন্যপাশে সবুজের আঁচল বিছানো চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের দিকে তাকালে মনে হয় যেন এরা মেতে উঠেছে প্রকৃতির আপন উৎসবে। আমাদের ট্রলার চর ঘেঁষে চলছে। চরে হাজার হাজার অতিথি পাখি। ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ শুনে ঝাঁক বেঁধে উড়তে শুরু করল। শত শত পাখি খুব কাছ থেকে দেখা এর আগে আমাদের সৌভাগ্য হয়নি। এমন রোমাঞ্চকর মুহূর্তে নিজেদের আর আটকে না রাখতে পেরে আমরাও বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে উঠলাম। ওরাই যেন আমাদের উল্লাস উপভোগ করছে। ইতিমধ্যে আমাদের ট্রলার সাচিলাপুর এসে পৌঁছে গেছে, তবে উঠতে কী আর মন চায়!

তার পরও আমরা একে একে সবাই পিচ্ছিল পথ বেয়ে উঠলাম রাস্তায়। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলছি আমাদের গন্তব্য ‘সাচিলাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। আমাদের ট্রলার যেখানে ঘাট দিয়েছে তার কাছাকাছি একটা বিয়ে বাড়ি। বিয়ে বাড়ির লোকজন ভাবছে বরযাত্রী বুঝি চলে এসেছে, কারণ তারাও ট্রলারে আসার কথা, তাই তারা এগিয়ে নিতে আসছে। মেহেদী ভাই আমাকে বলে উঠল, ‘ছোট ভাই বিয়েটা আজ করেই যাব নাকি’? বললাম, ‘আমার আপত্তি নেই’। মেহেদী ভাই আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই, আমার থেকে দুই বর্ষ এগিয়ে। তবুও তার সঙ্গে আমার অন্য রকম এক সখ্য। এলাকায় স্থানীয় লোকজন ভাবছে আমরা কোনো এনজিও থেকে ত্রাণ দিতে এসেছি। এক চাচি গরুর গোবর লাঠির সঙ্গে শুকাতে দিচ্ছে, এক হাতে লাঠি ধরে অন্য হাত দিয়ে মুড়িয়ে মুড়িয়ে দিতে দিতে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল ‘স্যার আপনারা ত্রাণ দেবেন’? প্রত্ত্যুরে আমরা যখন বললাম, ‘না চাচি আমরা শহর থেকে পিকনিকে এসেছি আপনাদের গ্রামে’। চাচি তখন মুখ বাঁকিয়ে বললেন, পিকনিকে! তখন মনের মধ্যে অপরাধ বোধ জাগল। আসলেই কী গ্রামে পিকনিকে এসে অপরাধ করে ফেলছি।

সাচিলাপুর স্কুলে আগে থেকেই আমাদের আহ্বায়ক টিম পৌঁছে গিয়েছিল। সবাই জার্নি ও ক্ষুধায় খানিকটা ক্লান্ত। আহ্বায়ক টিম খিচুরি রান্না করে রেখেছিল। সবাই তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে মেতে উঠলাম শৈশবের আমেজে। আমাদের যেন সবার বয়সের খাতা এখন ৬ থেকে ১০-এর মধ্যে। হারিয়ে যাওয়া রঙিন শৈশবকে আমূলে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। সবাই মেতে উঠল গোল্লাছুট, বউদৌড়, ঝুড়িতে বল ফেলা, কানামাছি, বালিশ বদল খেলায়। এর সঙ্গে আমরা ক্রিকেট খেলেছিলাম সেলিব্রিটি লিগের আদলে।

সারা দিন হুইহুল্লা করে আনন্দে মেতে ওঠে, সময় ফুরিয়ে এসেছে পশ্চিমাকাশে গোধূলি নেমে এসেছে। অতঃপর সবকিছু গুছিয়ে আমরা রওনা দিলাম নীড়ের পথে। সারা দিন মজায় মেতে থাকলেও ট্রলারে এসে গা এলিয়ে দিলাম। সারা দিনের ক্লান্তি অবসাদ যেন দেহখানায় জেঁকে বসেছে। ট্রলারের বেঞ্চে গা এলিয়ে দিতে দিতে ভাবলাম শত ব্যস্ততার মধ্যেও এমন রিফ্রেশ জীবনে বারবার দরকার আছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close