মো রিয়াজ হোসাইন, বাকৃবি

  ০৪ আগস্ট, ২০২৪

এলডোরাডো-৬০-এর পাহাড় ভ্রমণ

ভালো থাকার জন্য শরীর ও মনের সুস্থ থাকা চাই। কারণ শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক সুনিবিড়। শরীর সুস্থ থাকলেই মন সুস্থ থাকবে। অন্যদিকে মন অসুস্থ হলে শরীর অসুস্থ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। শরীর সুস্থ থাকার জন্য যেমন ভেজালমুক্ত খাদ্য জরুরি, তেমনি মনের সুস্থতার জন্য প্রকৃতির গাঢ় পরিবেশের সংস্পর্শে থাকা চাই। দুর্ভাগ্য, টিউশনি এবং পড়াশোনার চাপে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হয় না। ফলে সহজেই একঘেয়েমি এবং ক্লান্তি চলে আসে। বাকৃবিতে সারা বছর ক্লাস পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। অবশ্য ভেটেরিনারি অনুষদে ক্লাস এবং অ্যাসাইনমেন্টের চাপ অন্যান্য অনুষদের থেকে একটু বেশি।

বর্তমানে আমাদের সঙ্গে ভেটেরিনারি অনুষদে ২০২০-২১ সেশনে ১৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। যাদের মধ্যে চারজন শিক্ষার্থী নেপালি এবং ১০ শিক্ষার্থী মালয়েশিয়ান। ব্যবহারিক ক্লাসের সুবিধার্থে ২০০ জন শিক্ষার্থীকে ১০টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, প্রত্যেক গ্রুপের মধ্যে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য এবং বিভিন্নতা। শিক্ষার্থীরা গ্রুপকে বিভিন্ন ধরনের নাম দিয়েছেন। তেমনি আমাদের গ্রুপের নাম হচ্ছে এলডোরাডো-৬০, যা বাকৃবি ভেটেরিনারি অনুষদের ৬০তম বেঞ্চের শিক্ষার্থীদের ইঙ্গিত করে।

বাকৃবিতে শুক্র এবং শনিবার ক্লাস বন্ধ থাকার সুবিধার্থে গ্রুপের সবাই সিদ্ধান্ত নেই একঘেয়েমি দূর করার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন কোথাও ঘুরতে যাওয়ার। অবশেষে গ্রুপে আলোচনা শেষে শেরপুর জেলার মধুটিলা ইকোপার্ক এবং গজনী অবকাশে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রাজি হয়। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাই এবং সিদ্ধান্ত হয় শনিবারে যাব। ঘড়ির কাঁটায় যখন সাড়ে ছয়টা, তখন সবাই নিজ হল থেকে বের হয়ে শেরপুরে যাওয়ার জন্য রওনা হই। সময়মতো সাতটার বাস পেয়েও যাই। বাস কনড্রাক্টরদের সঙ্গে দর-কষাকষি শেষে বাসে উঠে পড়ি।

প্রায় দেড় ঘণ্টাখানেক বাস চলার পর শেরপুর পৌঁছাই। পরে শহরের হোটেলে নাশতা শেষে দুটি আট সিটের সিএনজি ভাড়া করি। তাদের সঙ্গে দর-কষাকষি হয় সারা দিন পাহাড় ঘোরার। শেরপুর শহর থেকে ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর প্রথমে সবাই মধুটিলা ইকোপার্কে যায়। সেখানকার উঁচু উঁচু পাহাড়, প্রকৃতির শান্ত মনোরম পরিবেশ এবং গাছে গাছে বাহারি রঙের ফুল আমাদের মুগ্ধ করে। ঘণ্টাখানেকের জন্য নেটওয়ার্কের বাইরে প্রকৃতির নিবিড় পরিবেশে মিশে যায়। গ্রুপের সবাই উল্লাদ বনের ভেতরে প্রবেশ করতেই একজন বন কর্মকর্তা এসে সতর্ক করল বনের ভেতরে না যেতে। তিনি জানালেন, ‘বন্যহাতির দল গতকাল থেকে এখানে ঘোরাফেরা করছে।’ প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরক্ষণই মনের ভেতর দ্বিগুণ উৎসাহ জাগে বন্যহাতি দেখার।

আমরা বন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জেনে নিই এখানকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড় কোনদিকে। তার নির্দেশমতো আমরা সেই পাহাড়ের দিকে যেতে থাকি। পথের মধ্যে বন্যহাতির মলমূত্র আমাদের পাহাড়ে ওঠার উৎসাহকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। পাহাড়টা বেশ উঁচু ছিল। অনেক কষ্টে আমরা পাহাড়ের শিখরে পৌঁছাই। পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই চারদিকে ঘন বন আর সবুজবৃক্ষের সঙ্গে দমকা হাওয়া আমাদের সমস্ত ক্লান্তিকে এক মুহূর্তে দূর করে নতুন করে উৎসাহের জন্ম দেয়। আমরা পাহাড়ের চূড়ায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করি এবং বন্যহাতির পাল দেখার জন্য উঁকি দিতে থাকি। ভাগ্য সহায় না থাকায়, অবশেষে আমরা বন্যহাতির পাল না দেখেই পাহাড় থেকে নেমে পড়ি। পাহাড় থেকে পরের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রওনা হতেই কয়েকজন আদিবাসীর সঙ্গে দেখা হয়। তাদের নানা সংগ্রামের কথা আমাদের বিমোহিত করে। এদের একজন বিজয় বাম বলেন, ‘পাহাড়ে বসবাসের সময় মাঝেমধ্যেই বন্যহাতির আক্রমণের শিকার হতে হয়। ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে কয়েক কিলোমটিার হেঁটে যেতে হয়। পাহাড়ে কেউ সুস্থ হলে তাদের হাসপাতালে নিতে নিতেই মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে।’

আমরা প্রায় ছোট-বড় ১০টা পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিলাম। পরবর্তী গন্তব্য মধুটিলা ইকোপার্ক থেকে প্রায় আধঘণ্টা দূরত্বের গজনী অবকাশে পৌঁছাই। সেখানকার চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। আমাদের প্রাণবন্ত করে। দুই পাহাড়ের মাঝে ঝুলন্ত সেতু, লেকের ওপর ভাসমান ড্রামের ব্রিজ, কেবল গাড়িতে ভ্রমণ বেশ মজার ছিল। আদিবাসীদের সংগ্রামের কথা এবং গাঢ় সবুজ পাহাড়ের উপভোগ শেষে সবাই খাওয়া-দাওয়া এবং বিশ্রামের জন্য বন্ধু রিয়াজের বাসায় যাই। তার বাড়ির চমৎকার খাবারের আয়োজন এবং বাহারি খাবারের প্রকার বেশ সুস্বাদু ছিল। রাতের ভুজভুঁড়ি শেষে সবার সঙ্গে গল্প মেতে উঠি। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার উদ্দেশে রাত আটটার বাসে উঠি। প্রায় ঘণ্টাখানেকের ভেতর আমরা নিরাপদে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাই। সর্বশেষ কবি মহাদেব সাহার কবিতা দিয়ে শেষ করতে চাই, ‘স্মৃতি ছাড়া কোন নোটবুক নাই, টুকে রাখি কোথা ইট বা খোয়াই’।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close