মাহমুদুল হাসান, নোবিপ্রবি
চাঁদরাতের স্মৃতি!
‘ঈদ’ শব্দটার সঙ্গে যতটুকু সম্পর্ক ‘খুশি’ শব্দটার, ঠিক ততটুকু সম্পর্ক থাকে ‘স্মৃতি’ শব্দটিরও। জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে বড় হতে হয়। বড় হতে গিয়ে খেয়াল করে তার সঙ্গে আনন্দ-খুশি শব্দগুলোর সংশ্লিষ্টটা কমে যাচ্ছে। তখন এই যান্ত্রিক জীবনে একটুখানি আনন্দের পরশ পেতে মানুষ দ্বারস্থ হয় স্মৃতির।
ঈদ প্রতিটা মানুষের জীবনেরই অন্যতম আনন্দের স্মৃতির অনুষঙ্গ। আমি যখনি আমার শৈশব স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে যাই, তখন খেয়াল করি ঈদ উদযাপনের স্মৃতিগুলো সবচেয়ে বেশি আনন্দের এবং সেগুলো ভাবলে অজান্তেই যান্ত্রিক শরীরে আটকা পড়া ভেতরের শৈশবটা বেরিয়ে আসতে চায়।
আমার মতো যারা শৈশবটাকে গ্রামে কাটিয়েছে, তাদের ঈদ উদযাপনের স্মৃতিগুলো নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি আনন্দের ছিল। মনে আছে যখনই পশ্চিম আকাশের বুকে ঈদের বাঁকা চাঁদ একগাল হাসি দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিত তখন আমরাও চাঁদের হাসির প্রতি-উত্তরে অট্টহাসি দিয়ে একঝাঁক কিশোর ভুঁ দৌড় দিয়ে মিছিল শুরু করতাম। হাতে মশাল জ্বেলে দুদিন আগে কিনে আনা বাজি ফাটিয়ে আমাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করতাম। কত ছোট ছোট জিনিসে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দের অনুভূতি তা ভেবে সত্যিই আপ্লুত হয়ে যাই।
বেশি রাতে বাসায় ফিরলে বাবা বকা দেবে এই ভেবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসায় ফিরে আসতাম যদিও ভাবতাম এমন খুশির রাতেও কেন বড়রা বকা দেয়? আমি কি এখনো ছোট? বাসায় ফিরেই বিটিভিতে শুনতাম জাতীয় কবি নজরুলের কালজয়ী ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটি। আর সারা বাড়িতে ধুম পড়ত মেহেদি দেওয়ার। খুব করে চাইতাম বড়দের মতো আমিও সারারাত সজাগ থাকব। ইশ! এই রাতটাকে যদি বেঁধে রাখা যেত, তাহলে কি মজাই না হতো! সন্ধ্যার পর পড়তে বসার জন্য কেউ বলত না। খালামণির সঙ্গে, নানুভাইয়ের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করা কিংবা শহর থেকে আসা কাজিনদের সঙ্গে খুনসুটি করতে পারতাম। আর আফসোস করে বলতাম, ‘প্রতিটি রাত ঈদের আগের রাত হয় না কেন?’ সেদিন গত হয়েছে কতকাল আগে! এখন অবশ্য রাতে দেরি করে বাসায় ফেরা নিয়ে ভয় লাগে না। সময়ের বিবর্তনে ভয়গুলো ছুটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদের আনন্দগুলোরও ছুটি হয়ে গেছে। মনে পড়ে এক ঈদে হাতে বড় আপুদের মতো মেহেদি পড়ে ঈদগাহে গিয়েছিলাম। আমার এক কাকু তখন বলেছিল মেহেদি ছেলেরা হাতে লাগায় না। হয়তো মেয়েরা নয়তো ছোট বাচ্চারা হাতে লাগায়। তখন ঈদগাহ থেকে বাসায় এসে সে কি কান্না! ছোট থাকতেই বড়দের মতো চাওয়ার মানসিকতা থাকায় ঈদের দিন হাতে মেহেদি পরা যেন আমায় বড় হতে চাওয়ার প্রচেষ্টায় বাধা দিচ্ছে, এই ভেবে আর কোনো দিন মেহেদি দিইনি!
তখন থেকেই হয়তো একটা অলিখিত ভাবনা মনে গেঁথে গিয়েছিল, বড়দের সবকিছুতে আনন্দের উৎস খুঁজতে নেই। এখন সেই ধারায় আস্তে আস্তে সত্যিই আমার আনন্দগুলোর উৎস সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। অন্য সাধারণ রাতগুলোর সঙ্গে আমি এখন ‘চাঁদরাতের’ বিশেষত্ব খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে গেছে। এখন শুধু মস্তিষ্কের স্মৃতিপটে একটি কিশোর চাঁদ রাতে একটি মশাল হাতে দৌড়ে ঈদকে উদযাপনের প্রস্তুতি নিতে থাকা ঝাপসা ছবি ভেসে আসে!
"