reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ৩১ মে, ২০২৩

রশিদুন নবী সম্পাদিত ‘নজরুলসংগীত সংগ্রহ’

তিন সহস্রাধিক নজরুলসংগীতের সম্মিলন

দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৮ নম্বর সেক্টরে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগে। ড. রশিদুন নবীর আরেক পরিচয় তিনি দুই বাংলার মধ্যে সর্বাধিকসংখ্যক নজরুলসংগীতের সংকলন- গ্রন্থ ‘নজরুলসংগীত সংগ্রহ’-এর সম্পাদক। তার সঙ্গে কথা বলেছেন মো. আশিকুর রহমান

কবি নজরুল সুস্থ অবস্থায় গান লিখেছিলেন তিন সহস্রাধিক। গানের বই প্রকাশিত হয়েছিল ১১টা, সেখানে গান ছিল ৭১৩টি। কবি অসুস্থ হওয়ার পর আরো কয়েকটি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কবির পরিবারের পক্ষে কবির সাহিত্যকর্ম সঠিকভাবে সম্পাদনা সম্ভব হয়নি। নজরুলের নয় এমন গানও কোনো কোনো বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। মূলত বাজারে নজরুলের বইয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশকরা তখন এমন কাজ করেছিলেন। তবে নজরুলের সব গানের মিলিত কোনো সংকলন ছিল না।

ফলে শিল্পী, শিক্ষার্থী কিংবা গবেষকদের কাছে নজরুলসংগীতের শুদ্ধ সুর ও বাণীর সমন্বয়ে একটা সংকলনের চাহিদা ছিল দীর্ঘদিনের। অধ্যাপক রশিদুন নবী নীরবে এই কাজটিই করে আসছিলেন। একসময় সংকলন করলেন নজরুলসংগীতের সবচেয়ে বড় সংকলন-  নজরুলসংগীত সংগ্রহ। কবির তিন হাজারের বেশি গান লিপিবদ্ধ আছে বইটিতে।

রশিদুন নবী পদ্ধতিগতভাবে নজরুলসংগীতের চর্চা শুরু করেন ১৯৮০ সালে নজরুল একাডেমিতে। তখন বিভিন্ন শিক্ষকের সঙ্গে সংগীত বিষয়ে আলাপ জুড়ে দিতেন। তবে বেশির ভাগ সময়ই তিনি তার জানার আগ্রহ অনুযায়ী উত্তর পেতেন না। পরে নজরুলকে নিয়ে লেখা বই কেনা এবং পড়া শুরু করেন। পত্রপত্রিকায়ও নজরুলকে নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। নজরুরসংগীতের প্রতি রশিদুন নবীর আগ্রহ, চেষ্টা, ভালোবাসা, আন্তরিকতা অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষেরও নজরে আসেন। সে সময় অ্যাকাডেমি নজরুলের যথার্থ গানের সুর ও বাণীসংবলিত বই প্রকাশ করত শুধু আদি গ্রামোফোন অর্থাৎ নজরুলের সুস্থ অবস্থায় যেসব রেকর্ড প্রকাশ হয়েছিল, সেখান থেকে। নজরুল অ্যাকাডেমি-বিষয়ক দশটি খণ্ড প্রকাশ করে। ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ খন্ডটির স্বরলিপি প্রণয়ন করেছিলেন রশিদুন নবী। এটিই তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ।

১৯৮৯ সালে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে নজরুল ইনস্টিটিউটে যোগ দেন রশিদুন নবী। পরে সহকারী পরিচালক হয়েছিলেন। ইনস্টিটিউটের গবেষণা এবং সংস্কৃতি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি প্রায় ২২ বছর খণ্ডকালীন প্রশিক্ষক হিসেবে নজরুল একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও নজরুল পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

নজরুল ইনস্টিটিউটে যোগদানের পরপরই রশিদুন নবীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থসমূহের স্বরলিপি ধৃত গানগুলোর বাণীর পাঠান্তর নির্দেশের। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আসাদুল হক প্রণীত নজরুলসংগীত স্বরলিপি গ্রন্থের নজরুলসংগীতে বাণীর ক্ষেত্রে পাঠান্তর পরিবর্তনের তুলনামূলক তালিকাটা তৈরি করেছিলেন তিনিই।

তবে তিন সহস্রাধিক নজরুলসংগীতের সংকলন প্রকাশের সুবিশাল কর্মযজ্ঞ প্রাতিষ্ঠানিক মাত্রা পায় ২০০৫ সালে। তৎকালীন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক জানতে পারেন যে রশিদুন নবী প্রায় দেড় দশক নজরুলসংগীতের সংকলনের কাজ করছেন। তিনি রশিদুন নবীর সম্পাদিত পা-ুলিপি দেখলেন। জানলেন বাংলাদেশে নজরুলসংগীতের সংগ্রহ নিয়ে এত বিশাল পরিসরে কখনো কাজ হয়নি। বিষয়টি ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় উপস্থাপন করেন। সেখানে এটি বই আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। রশিদুন নবীর ভাষায় ‘কাজটি ছিল জটিল, শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ।’

তবে স্বত্ব-সংক্রান্ত একটা জটিলতা ছিল। নজরুল জীবদ্দশায় অনেক গানের স্বত্ব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। অনেকের কাছে বাণী বা রেকর্ড থাকলেও তারা দিতে অনাগ্রহী ছিলেন। অনেকে আবার উচ্চমূল্যের বিনিময়ে বা শর্তজুড়ে দিয়ে ছাড়তে রাজি হয়।

অবশেষে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে এই সংকলন প্রকাশিত হয়। বইটির প্রথম মুদ্রণে ৩১৬৩টি গান ও ৩০৭৯টি গানের বাণী দেওয়া সম্ভব হলেও অবশিষ্ট ৮৪টি গান উদ্ধার বা সংগৃহীত না হওয়ায় সেগুলোর বাণী দেওয়া সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সংস্করণে গান রয়েছে ৩১৭৪টি! এত অধিক সংখ্যক নজরুলসংগীতের বাণীসংবলিত সংকলন এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি।

নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত আদি রেকর্ডভিত্তিক নজরুলসংগীতের বাণী সংকলন গ্রন্থের এক হাজার গানের বাণীও বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। নজরুলসংগীতের আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের এক বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউটে। এসব রেকর্ডের গান শুনে সেগুলোর বাণী অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ সম্পর্কে রশিদুন নবী বলেন, ‘অনেক গ্রামোফোন। রেকর্ডের বাণী খুবই অস্পষ্ট, ঠিকমতো বোঝা যায় না। যেগুলো বোঝা যায়, সে গানগুলোর ভুল সংশোধন করা হয়েছে।’

এ ছাড়া ভারতের প্রখ্যাত নজরুলসংগীত বিশেষজ্ঞ ড. ব্রহ্মমোহন ঠাকুর লিখিতভাবে তার সংগ্রহে থাকা নজরুলসংগীতের আদি রেকর্ডে থাকা গানগুলো নজরুল ইনস্টিটিউটকে প্রদানের জন্য লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার প্রস্তাব এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের আগ্রহে ১৯৯৮ সালে সুধীন দাশ ও রশিদুন নবী কলকাতা যান। বাংলাদেশে সঠিকভাবে নজরুলসংগীতের চর্চা হচ্ছে। কিন্তু কলকাতায় তেমন কিছুই হচ্ছে না, বরং অবস্থা খুবই করুণ এমন আক্ষেপ করে ড. ঠাকুর প্রায় দেড় হাজার গান বিনা মূল্যে হস্তান্তর করেন। এগুলোও এই সংকলনে স্থান পেয়েছে। কবির প্রায় ৪০০ লেটো গান এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এগুলোর শীর্ষভাগ গানের আগে কোনো সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ভারতের গবেষক মুহম্মদ আয়ুব হোসেনের কাছ থেকে।

গান সংগ্রহ করতে গিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। খুব সহজেই যে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গান পেয়েছেন বিষয়টা এমন না। ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত সৈয়দ আবদুর রব সম্পাদিত মুয়াজ্জিন পত্রিকায় নজরুলের একটা গান প্রকাশিত হয়েছে এমন একটা তথ্য তার কাছে ছিল। সেই নির্দিষ্ট সংখ্যাটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। রশিদুন নবীর ভাষ্য, আমি মূলত দুটো গান খুঁজছিলাম। বাংলা একাডেমির পুরোনো সংগ্রহশালায় খুঁজেছি বেশ কদিন। পরে যখন সেই সংখ্যাটি পাওয়া গেল সে সময় দেখা গেল যে পাতায় গানটি ছিল, সেটি ছেঁড়া। আরেকটা গান পেলাম না। পত্রিকার সম্পাদকের নাতনি আবার আমার পূর্বপরিচিত। তিনি পরে দীর্ঘ সময় নিয়ে খুঁজে আমাকে একটি গানের ছবি তুলে পাঠিয়েছেন। বাকি একটা গান এখনো খুঁজছি।

এমনো হয়েছে, যার কাছে রয়েছে তিনি দেবেন, কিন্তু তার স্ত্রী-সন্তান দিতে দেবেন না বা মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করে বসলেন। যে এলাকার যাতায়াত বা অবকাঠামোগত অবস্থা ভালো না। দেখা গিয়েছে সারারাত ছাড়পোকার সঙ্গে থেকে কদিন ঘুরেও পাচ্ছেন না কিছুই।

বইটিতে অন্তর্ভুক্ত কিছু গানের বাণী সংশোধনের ব্যাপারে সহযোগিতা পেয়েছেন ফিরোজা বেগম, সোহরাব হোসেন, সুধীন দাশ, আসাদুল হক, ফেরদৌসী রহমান, খালিদ হোসেনসহ নজরুলসংগীত বোদ্ধা ও শিল্পীদের।

সেই সময়টায় এমন হয়েছে সকালে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে গিয়ে কাজ শুরু। কাজ করেছেন রাত এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে আবার কাজ শুরু, চোখ লেগে গেছে এমন সময় তার স্ত্রী এক কাপ চা হাতে হাজির। তিনি বলছেন, চা পান করে আবার পূর্ণ স্পৃহায় কাজ শুরু করতে। স্ত্রী মাহবুবা সুলতানার কাছ থেকে সব সময়ই এমন সাপোর্ট পেয়েছেন তিনি। পা-ুলিপি প্রস্তুত থেকে প্রুফ দেখা পর্যন্ত সব সময়ই পাশে ছিলেন তিনি। সহযোগিতা করেছেন নানাভাবে।

প্রফেসর ড. রশিদুন নবী বলেন, ‘নজরুলসংগীত সংগ্রহ’ বইটি বিশ্বব্যাপী নজরুল গবেষকদের, নজরুলপ্রেমীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে এটা আমার কাছে প্রাপ্তির। নজরুলসংগীতের একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলনের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও অনেক নজরুলপ্রেমী ও শুভাকাক্সক্ষীদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছি। তিন সহ¯্রাধিক গান একই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা সহজ ছিল না মোটেই।

এ বছর নজরুলের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের কলকাতার সংবিদ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত (*হতে যাচ্ছে/হয়েছে) রশিদুন নবীর ‘নজরুলসংগীতের ভবনে অন্যান্য গীতিকারের গান’ শিরোনামের বই। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলা গানের এক অমূল্য সম্পদ নজরুলসংগীত। দীর্ঘকাল ধরে অজ্ঞতা কিংবা অসতর্কতার কারণে নজরুল গবেষক, সম্পাদক, সংকলক ও স্বরলিপিকারদের মাধ্যমে নানা গ্রন্থে এবং বেতার-টেলিভিশনে সংগীতশিল্পীদের মাধ্যমে নজরুলের সমসাময়িক বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট গীতিকারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গান নজরুলসংগীত হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে। অন্যান্য গীতিকার রচিত এ ধরনের প্রায় তিন শ গান চিহ্নিত করে নানা তথ্য-উপাত্তসহ আলোচনা হয়েছে এই গ্রন্থে। পাঠকের সুবিধার্থে গ্রন্থটির পরশিষ্টাংশে এ যাবৎ সংগৃহীত নজরুলসংগীতের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সন্নিবেশিত হয়েছে।

তার সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা চৌদ্দটি, নজরুলসংগীতের প্রামাণ্য স্বরলিপি-গ্রন্থ পাঁচটি এবং দেশি-বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংখ্যা অর্ধশত। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে কবি নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে পেয়েছেন ‘নজরুল পুরস্কার-২০১৭’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ার নজরুল একাডেমি থেকে নজরুল-পুরস্কার-২০১৮’সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close