মো. লিখন ইসলাম, বাকৃবি

  ২৮ মে, ২০২৩

গবেষক তৈরির কারিগর যারা

শৈশবে কমবেশি সবাইকেই বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন বা শিক্ষকরা একটা প্রশ্ন করেছেন, বড় হয়ে কী হতে চাও? আমরাও গভীর আবেগ নিয়ে উত্তর দিয়েছি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট কিংবা আইনজীবী হতে চাই। কিন্তু কেউ কখনো বলেনি আমি গবেষক হতে চাই। কেননা ছোটবেলায় আমাদের চিন্তার জগৎ গড়ে দিয়েছেন আমাদের আশপাশে বাস করা প্রিয়জনরা।

একটা দেশ তখনই উন্নতি করে যখন সেই দেশ গবেষণা করে নিত্যনতুন প্রযুক্তি বা মানবজীবনে কল্যাণকর এমন কিছু আবিষ্কার করে। এই গবেষণার জন্যই পৃথিবী আজ এত উন্নত। ইউরোপ আমেরিকার এই চোখধাঁধানো উন্নয়ন এমনি এমনি আসেনি এর পেছনে আছে নিরলস গবেষণা। তারা গবেষণায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে বলেই আজ তারা বিশ্ব নন্দিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের শেষ দিকে এবং স্নাতকোত্তরে থাকে থিসিস বা প্রজেক্ট। এই কোর্সগুলো পুরোটাই রিসার্চনির্ভর। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় এগুলো করতে গিয়ে শিক্ষকের বকা খাইনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গবেষণায় সঠিক জ্ঞান না থাকায় অনেকেরই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, যা একজন নবীন গবেষকের জন্য মানসিক চাপের সৃষ্টি করে।

আবার অনেকের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য বহির্বিশ্বের যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে কিন্তু এখানেও বাদ সাধে ওই গবেষণায় অভিজ্ঞতা না থাকা। কারণ উন্নতর দেশগুলোর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনুষদ বা রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করার জন্য তারা দক্ষ এবং গবেষণা পেপার প্রকাশিত হয়েছে এমন কাউকে খোঁজে।

এই বিড়ম্বনার কথা চিন্তা করেই একজন উদ্যোগী, স্বপ্নবাজ তরুণের হাতে ধরে গড়ে উঠে বায়োপিসি (BioPc–A Bioinformatics Lab of Research & Training) নামক একটি অলাভজনক গবেষক তৈরির সংস্থা, যাদের উদ্দেশ্যে একদল দক্ষ, উদ্যমি গবেষক তৈরি করা। যারা গবেষণা ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে উন্নত দেশের সঙ্গে সমানতালে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারে।

বায়োপিসির পথচলার শুরুটা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী মো. হৃদয় আহমেদের হাত ধরে। বায়োপিসি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বায়োইনফোরম্যাটিকস ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজিভিত্তিক একটি স্বেচ্ছাসেবী গবেষণা সংগঠন। হৃদয়ের প্রতিষ্ঠিত বায়োপিসি নামক সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বায়োইনফরমেটিকসের বিভিন্ন ফিল্ডে ট্রেইনিং করানো, রিসার্চ মেথডোলোজি শেখানো, গবেষণা প্রজেক্টে যুক্ত করা, রিসার্চ পেপার পাবলিকেশনে সাহায্য করা ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন দিকে নির্দেশনা প্রদান করা। বর্তমানে বায়োপিসির সঙ্গে বেশ কয়েকজন দেশি ও বিদেশি প্রশিক্ষক যুক্ত রয়েছেন। যারা বায়োইনফরমেটিকসের বিভিন্ন ফিল্ডে খুবই দক্ষ। তদের মধ্যে অন্যতম ড. ফাইজুল আলম, যিনি সৌদি আরবের স্বনামধন্য কাসিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারমাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপক, আছেন গগনদীপ সিং খোরানা, যিনি বর্তমানে ভারতের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পিএইচডিরত শিক্ষার্থী। এ ছাড়া আছেন অমিত কুমার দত্ত তিনি বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত এবং নুরে সারাফ নাওয়ার সামিয়া তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিরবির ভাইরোলজি ও জিনোমিকস ল্যাবে সহকারী গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন।

সম্প্রতি সংস্থাটি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করতে ও স্নাতক লেভেলে গবেষণায় যুক্ত করে রিসার্চ পেপার পাবলিকেশনের উদ্দেশ্যে মাসব্যাপী আয়োজন করে ফ্রি ট্রেইনিং সেশন। যেখানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আবেদনের ভিত্তিতে ২০০ জন বাছাই করা শিক্ষার্থীকে সুযোগ দেওয়া হয়। ট্রেইনিংটিতে ৬টি সেশন নেওয়া হয়, যেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তরে পড়ুয়া এসব ছাত্রছাত্রীকে ড্রাগ ডিজাইন, ভ্যাকসিন ডিজাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শেখানো হয়। এর মধ্য থেকে অ্যাসাইনমেন্ট আর কুইজ টেস্টের ফলাফলের ভিত্তিতে ২০০ জন থেকে সেরা ত্রিশজনকে বাছাই ও ক্রেস্ট দেওয়া হয়। পরে এই সেরা ত্রিশজনকে সরাসরি ৫টি গবেষণা প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ প্রদান ও রিসার্চ পেপার পাবলিকেশনের সুযোগ দেওয়া হয়।

এই সেরা ত্রিশজনের অন্যতম একজন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী অর্ণব সাহা তার অনুভূতি ব্যক্ত করার সময় বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এসব ইভেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। এই ইভেন্টে ফ্রিতে গবেষণার প্রক্রিয়াগুলো শেখানো এবং গবেষণা করার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে, যা বাংলাদেশের উন্নয়নের বিরাট একটি সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।’ বায়োপিসির প্রতিষ্ঠাতা মো. হৃদয় আহমেদ অতি সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত ‘ডারউইন ইন্টারন্যাশনাল ভার্চুয়াল কনফারেন্সের ৪র্থ ইডিশন’-এ ৪৬ দেশের প্রায় ৫৬ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে বেস্ট রিসার্চ পেপার প্রেজেন্টেশন অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

তার প্রতিষ্ঠিত সংস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেদের পাশাপাশি সব শিক্ষার্থীকে গবেষণা ও বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করছি। এর পাশাপাশি আমি স্বপ্ন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা গবেষণামুখী হবে ও উচ্চশিক্ষায় দেশের বাইরের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে সম্মানের সঙ্গে কাজ করবে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে এসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এগিয়ে আসা উচিত যাতে করে শিক্ষার্থীরা গবেষণা এবং গবেষণাবিষয়ক বিভিন্ন জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি হয়।’

বর্তমানে বায়োপিসির অধীনে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ৩০ জন শিক্ষার্থী কম্পিউটেশনাল বায়োলজি ফিল্ডে গবেষণার কাজে লিপ্ত রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close