reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৪ মে, ২০২৩

তরুণদের ভাবনায় কবি নজরুল

কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু কবিই নয়, ছিলেন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক বীরযোদ্ধা। তিনি কবিতা আর গানে জাগিয়ে গেছেন বিদ্রোহ। তাই তো তাকে বলা হয় বিদ্রোহী কবি। শুধু বিদ্রোহ নয়, তিনি শুনিয়েছেন প্রেমের আর বিরহের কবিতাণ্ডগানও। ১১ জ্যৈষ্ঠ তার ১২৪তম জন্মবার্ষিকী। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কবি নজরুলকে নিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক মিনহাজুল ইসলাম

ইংরেজদের বুকে ছুড়েছে বিষাক্ত তীর

বাংলা সাহিত্য জগতের নক্ষত্র কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন ধূমকেতুর ন্যায়। নজরুল আমৃত্যু গেয়েছেন মানবতার জয়গান। লিখেছেন

‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

শৈশব থেকে দুঃখ দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা নজরুলের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। ছোটবেলায় মাত্র ১২ বছর বয়সে যোগ দেন লেটোর দলে। দারিদ্র্য ঘুচাতে ১৯১২ সালে আসানসোলে কারিগর হয়েছিলেন চা-রুটির দোকানে। কবি, দার্শনিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, সৈনিক, সাংবাদিক, অভিনেতা প্রভৃতি বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী হয়েছিলেন দুখু মিয়া।

সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ ও মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় তার বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাপা হলে চারদিকে শুরু হয় প্রবল আলোড়ন, পরিচিতি পান বিদ্রোহী কবি হিসেবে। নজরুল তার জীবদ্দশায় ২৬০০-এর বেশি গান রচনা করেছেন। লিখেছেন বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকার মতো কালজয়ী উপন্যাস। তিনি কলম ধরেছিলেন শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। তার লেখনী ছিল শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে। যার ফলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তার বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, চন্দ্রবিন্দু ও যুগবাণী গ্রন্থগুলো। হয়েছেন কারাবন্দিও। তবু থেমে থাকেননি এ লড়াকু সৈনিক। জেলে বসেই রচনা করেন ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’। নজরুলই প্রথম ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেছিলেন তার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায়। ১৯৩১ সালে ধূপছায়া চলচ্চিত্র পরিচালনার মাধ্যমে নজরুল হয়ে ওঠেন ১ম বাঙালি মুসলমান চলচ্চিত্রকার। ‘ধ্রুব’ নামক একটি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। তার রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘খুকী ও কাঠবিড়ালি’ এবং ‘লিচুচোর’ নিয়ে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র। ১৯৪২ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি ‘পিকস ডিজিজ’ নামক এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। হারিয়ে ফেলেন কথা বলার শক্তি, সেই সঙ্গে স্মৃতিশক্তিও। তারও ৩৪ বছর পর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি ইহধামের মায়া ত্যাগ করেন।

নজরুল মানেই সাম্যবাদী মনোভাবের এক নক্ষত্র। সাম্যের জন্য লড়ে যাওয়া এক অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক, যার কলমের কালি ইংরেজদের বুকে ছুড়েছে বিষাক্ত তীর। আপন ভঙ্গিতে, আপন খেয়ালে, স্বকীয়তায় সাহসীকতার এমন লেখনী বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। দুরন্ত, সাহসী, মুক্ত খেয়ালিপনার এই মহামানবের জন্মদিনে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

মোসা. সাবজান্তা আমরিন

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আমার ছন্দের অনুপ্রেরণা কাজী নজরুল ইসলাম

কবি নজরুলের শব্দ ছন্দের দর্পণ বিদ্রোহী কবিতার ‘আমি’ শব্দটি। আমি কে? আমি কী চাই? সিন্দুক খুলে জন্ম নেওয়ার প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়ার যে নিরন্তন প্রচেষ্টা, সেই শব্দভাণ্ডারের মধ্যে, ন্যানো বিকিরণ গতির যে আত্মা, সেটাই আমি। দুখু মিয়ার লেখনী ধূমকেতুর আঘাতে ভারত ছেড়েছিল ব্রিটিশরা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজনীতিবিদের শব্দ শক্তির সঞ্চালক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল দুখু মিয়ার প্রতিটি পঙক্তি। ছোটবেলার কাঠবিড়ালি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্যবাদী, চক্রবাক, কুহেলিকা, মৃত্যুক্ষুধার সংস্পর্শে জীবনকে জ্ঞানের চূড়ায় পৌঁছে দিতে কবি নজরুলের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে থেকে, শব্দ মিশ্রণে লিখেছেন অসংখ্য গল্প-কবিতাণ্ডউপন্যাস ও গান। তা সত্ত্বেও তার লেখনীতে প্রেমের চিরসত্য, গুণগুণাগুণ ফুটে উঠেছে।

আমাদের মতো তরুণদের শিখিয়েছেন, বল বীর-বল উন্নত মম শির! এই তাল-লয় শব্দশফঙ্খলের মধ্য, আমরা আমাদের মস্তক না নত করার শক্তি খুঁজে পাই। জন্মজয়ন্তী শুভ দিন, দুঃখু মিয়ার জন্মদিন।

আলিমুল ইসলাম

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদ

নজরুলের আদর্শ বেঁচে থাকুক বাঙালি হৃদয়ে

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, যুদ্ধ, সাম্য, মনুষ্যত্ব এবং প্রতিবাদের কবি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই কবি আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য। সদা সোচ্চার ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে। তিনি লিখেছিলেন, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’ তিনি তার সৃষ্টিশীলতার প্রায় সব প্রয়াস মানব ধর্মের বিকাশের পথের বাধা দূরে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

তিনি এমন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার আলো কখনো নির্বাপিত হয় না। তার কাছ থেকে আমরা শক্তি গ্রহণ করতে পারি। তিনি আমাদের ভেতরের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যায়ের অনমনীয় চিত্তকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তাই তো লিখেছেন, ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির।’ আমাদের কাজী নজরুল প্রেয়সীর প্রতি প্রেমাবেগ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সবকিছুতেই যেন অনন্য। লেখনী তে তাই লিখেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণয়-তুর্য।’ নারীদের তিনি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিতে সদা সোচ্চার ছিলেন। নারী ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেন, পৃথিবীর সমস্ত কল্যাণে নারীদের ভূমিকা রয়েছে বলেন। তিনি লিখেছেন- ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর। অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

এই অনন্য কবির জন্মজয়ন্তীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। তার জন্মদিনে একটাই চাওয়া প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ে ও কাজে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, প্রতিবাদী, ও মনুষ্যত্বের জীবনাদর্শ ধারণ করুক। তবেই সুখী, সমৃদ্ধ, শান্তি ও আনন্দময় বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব।

তানজিনা আক্তার ইলহাম

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

তৃতীয় বর্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

তিনি দমে যাননি

বাংলাদেশের বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে একটি দরিদ্র পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন।

শৈশব থেকে তিনি ছিলেন দুরন্ত। অল্পবয়সে তিনি তার পিতাকে হারান। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করতে পারেননি বেশিদূর। ধরতে হয়েছে পরিবারের হাল। শৈশব থেকেই তাকে করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম। কখনো বা লেটোগানের দলে, কখনো মসজিদের ইমাম বা মোয়াজ্জিন, কখনো বা রুটির দোকানে কাজ করে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাকে। সাহিত্যের প্রতি ছিল তার দারুণ ঝোঁক। তিনি সারাজীবন ছিলেন অত্যাচারী ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

তিনি এ দেশকে এবং এ দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন অত্যাধিক। ১৯২২ সালে তার বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হলে তাকে ইংরেজ সরকার কারাগারে নিক্ষেপ করে। তার পরও তিনি দমে যাননি, সরে যাননি? সংগ্রামী পথ থেকে। তার বিখ্যাত কবিতা ‘চল চল চল’ বাংলাদেশর রণসংগীত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে ঢাকা আলিয়াকে তার নাম অনুসারে কবি নজরুল সরকারি কলেজ নামকরণ করেন। বর্তমান বাংলাদেশের এক অন্যতম বিখ্যাত কলেজ এটি। এ ছাড়া ২০০৬ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবির নামে ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজধানীতে কবির নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজের একজন শিক্ষার্থী হতে পেরে আমি গর্বিত।

মো. রোমান মোল্যা

শিক্ষার্থী, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ

কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close