আতিকুর রহমান, ইবি
জৌলুসহীন পদ্মায় আমরা
অভি ভাই ও শরীফ ভাই। দুজনই আমার পছন্দের মানুষ। সবদিক থেকেই আমার বড়। দুজনের মাস্টার্স কমপ্লিট। আর আমি সবেমাত্র তৃতীয় বর্ষে। আমাদের মধ্যকার দুষ্টুমি, ভালোবাসা, আদর, শাসন ও যত্নের দিকে তাকালে কেউ কল্পনা করতে পারবে না যে, তারা আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র। অনেক দিন ধরে ভাইদের দাওয়াত করছিলাম কুষ্টিয়া আসার জন্য। শরীফ ভাইয়ের ব্যাপারে বলা যায়, উনি আমার মেন্টর।
ভাইদের দাওয়াত করলে অনেক সময় উত্তরটা এমন হতো ‘হঠাৎ করে এক দিন চলে আসব’।
৫ মার্চ। সকাল বেলা অভি ও শরীফ ভাই কুষ্টিয়া এলেন। ৬ মার্চ আমি, মশিউর, অভি ভাই এবং শরীফ ভাই চলে গেলাম পদ্মায়। এর আগে পদ্মায় যাওয়া হয়নি। ফলে দারুণ একটা অনুভূতি কাজ করছিল। শিলাইদহ পদ্মা ঘাটে গিয়ে আমরা উপস্থিত হই। নৌকা দিয়ে পদ্মার চর গেলাম। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা রাজশাহী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, এখান থেকে নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করে। গঙ্গার অন্য শাখাটি ভাগীরথী নামে ভারতে হুগলীর দিকে প্রবাহিত হয়। পদ্মা প্রথমেই বিখ্যাত হয়েছে ইলিশ দিয়ে। এর মূল কারণ পদ্মার ইলিশ এত সুস্বাদু যে, গঙ্গার মাছকেও হার মানিয়ে দেয়। যদিও পদ্মার উৎস গঙ্গা। এর দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার, যা ৭৫ মাইলের সমান। আর অববাহিকা ৮০ বর্গকিলোমিটার অর্থাৎ ৩১ বর্গমাইল। পদ্মার মোহনা হচ্ছে মেঘনা নদী। পদ্মার সর্বোচ্চ গভীরতা ১ হাজার ৫৭১ ফুট অর্থাৎ ৪৭৯ মিটার। পদ্মার অনেক উপনদী আর শাখা নদী রয়েছে। পদ্মার প্রধান উপনদী মহানন্দা ও পুনর্ভবা। আবার পদ্মার বিভিন্ন প্রশাখার নদীগুলো হচ্ছে মধুমতী, পশুর, ভৈরব, যা কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী প্রভৃতি জেলার ওপর দিয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে। পদ্মা বাংলা সাহিত্যে অনেক খোরাক জুগিয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। যে উপন্যাসে এই নদীর তীরের মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে লেখা। এই বিখ্যাত উপন্যাসটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাক ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসটির উপজীব্য পদ্মাপারের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মা নদী নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন। যার শিরোনাম ‘পদ্মা’। সেই কবিতার পঙক্তিমালা হচ্ছে,
হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শতবার।
এক দিন জনহীন তোমার পুলিনে,
গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।
পদ্মার নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে আকৃষ্ট করেছে। কবি তাই তো গলা ছেড়ে অনায়াসে গাইতে পেরেছেন, ‘পদ্মার ঢেউ রে- মোর শূন্য হৃদয় নিয়ে যা যা রে’। পদ্মা নদীর রূপ নিয়ে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ‘হে পদ্মা! প্রলয়ংকরী! হে ভীষণ ভৈরবী সুন্দরী! হে প্রগলভা হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী তুমি শুধু নিবিড় আগ্রহ আর পার গো সহিতে একা তুমি সাগরের প্রিয়তমা, অয়ি দুর্বিনীতে!’
পদ্মার ভয়ংকর রূপ, বিশাল জলরাশী সবারই জানা। পদ্মার তর্জন-গর্জন এক আতঙ্কের নাম। বর্ষায় পদ্মার যখন যৌবন ফিরে আসত, উত্তাল ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ে গরিব-দুঃখী মানুষের ঘরবাড়ি, চাষের জমি নিয়ে যেত গভীর পদ্মায়। বর্তমানে পদ্মার ভয়ংকর রূপ আর এখন দেখা যায় না। পদ্মা পাড়ি দিতে এখন আর মাঝিমাল্লারা ভয় পায় না। গৃহবধূ এখন আর পদ্মায় মাছ শিকার করতে যাওয়া স্বামীর জন্য নিদ্রাহীন রাত কাটায় না।
আমরা পদ্মার চরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে আবার নৌকা দিয়ে ফিরে আসি শিলাইদহতে। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি দেখে রাতের বাসে ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। পদ্মার ভ্রমণ এক দিক থেকে যেমন রোমাঞ্চকর ছিল, অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাজ্ঞানের খাতায় যোগ করেছে।
"