সানজিদা জান্নাত পিংকি, গবি
রিকশার চাকায় ঘুরছে জীবন

দরিদ্র বাবার ইচ্ছে ছেলে কৃষিকাজ করবে, অভাবের সংসারে জুটাবে দুমুঠো অন্ন। কিন্তু অদম্য তরুণের স্বপ্নের কাছে তা যেন পাহাড়সম। পরিবারের দুর্দশা কোনোভাবেই তার মানসিক শক্তির কাছে জিতে না। তাই, সভ হার না মানার লড়াইয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন নিজেকে গড়ার চ্যালেঞ্জ। বলছি, সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ডলারের কথা। সব বাস্তবতার ঊর্ধ্বে গিয়ে যিনি শক্ত হাতে ধরেছেন নিজেকে গড়ার হাল। ডলার যার নাম তার জীবনে যেন ডলারেরই বড় সংকট। ফেরী করে কাপড় বিক্রি করা বাবার ঘরে অভাবই তার বড় কারণ। ৪ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তুলনামূলকভাবে পড়াশোনায় একটু দুর্বল হওয়াতে কোনোক্রমেই পরিবার তাকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ দিতে চায় না। কিন্তু, ইচ্ছেশক্তি দুর্বলতাকে সবলচিত্তে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাই ঘর পালিয়ে চলে এসেছেন দূরে, ভর্তি হয়েছেন মধ্যবিত্তের ভরসার প্রতিষ্ঠান গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হয়েছেন ঠিকই কিন্তু, ১ম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর বড় চিন্তা পড়ার খরচ জোগানো নিয়ে। এ দ্বার-ও দ্বার সব ঘুরে অবশেষে ভরসা রাখলেন নিজের পায়ে। বেছে নিয়েছেন তিন চাকার বাহন রিকশা। পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়েই ঘোরাচ্ছেন জীবনের চাকা। প্যাসেঞ্জার টেনে গড়ে যাচ্ছেন নিজের ভবিষ্যৎ।
অন্য বন্ধুরা যখন আড্ডায় ব্যস্ত তখন ক্লাস শেষে রিকশা চালিয়ে সেমিস্টার ফি তোলার জন্য শ্রম দেন এই শিক্ষার্থী। মোস্তাফিজের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আজমতপুরে। ৭ সদস্যের পরিবারে তার দুই ভাই-বোন কোনোক্রমে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারলেও মোস্তাফিজের উপয়ান্তর মিলে না। পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া কৃষিকাজের ওপর অভিমান করে ঘর ছাড়েন ৪ বছর আগেই। শিক্ষিত হওয়ার অদম্য ইচ্ছা তাকে বাধ্য করে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাতে। উচ্চমাধ্যমিকের পড়ার খরচ রিকশা চালিয়ে জোগাড় করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটা অঙ্কের খরচ তার দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়ায়। কোনো কিছুতেই তিনি দমে যাননি। পড়াশোনা, বইকেনা, বাসাভাড়া দেওয়া কষ্টসাধ্য হলেও দিন-রাত পরিশ্রম করে রিকশা চালিয়ে সে সবকিছুরই জোগান দিয়ে আসছেন। শুরুটা গ্যারেজের রিকশা ভাড়ায় নিয়ে হলেও ৪ বছরের জমানো টাকা দিয়ে নিজেই রিকশা কিনেছেন। অদম্য এই তরুণ এখন তার উপার্জিত অর্থের কিছু অংশ বাড়িতে থাকা তার মায়ের কাছেও প্রেরণ করেন। পড়াশোনায় এত বেশি আগ্রহ কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার লেখা ও কবিতার মাধ্যমে সমাজে শান্তির বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই পরিবারের সহযোগিতা না পেয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। অবসর সময়ে নিজের জীবন এবং দরিদ্রতা নিয়ে কবিতা লেখেন তিনি।
বাংলায় পড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাষ্ট্রে বিভিন্নভাবে বাংলা ভাষা ক্ষুণ্ন হয়। তাই আমি বাংলা ভাষা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বাংলার সংস্কৃতি সবার মাঝে তুলে ধরতে চাই। ভবিষ্যতে নিজেকে একজন বাংলার শিক্ষক হিসেবে দেখতে চান এই সংগ্রামী যুবক।
ভর্তির ক্ষেত্রে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ই কেন এই প্রশ্নে হার না মানা এই যুবক জানান, নিম্নবিত্ত ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, প্রতিবন্ধী এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, বিনা বেতনে অধ্যয়ন, টিউশন ফি ছাড়সহ নানা সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণে তিনি এখানে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে তিনি বৃত্তি কোটায় পড়াশোনা করছেন।
মোস্তাফিজের সহপাঠী আতিকুর রহমান শাওন বলেন, ‘মোস্তাফিজকে আমি ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার মানুষ হিসেবেই জেনেছি। নিজের প্রতিভার মর্যাদা দিয়ে নিজেকে বিকশিত করতে ঘর ছেড়েছেন তিনি। যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তচিন্তার মানুষ। কাজ ও পড়াশোনার পাশাপাশি দিনের অধিকাংশ সময়ই তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থাকেন। তিনি একজন লেখকও বটে। প্রায় তিনশো কবিতা রচনা করেছেন। তিনি যেমন কর্মে অদম্য তেমনি জ্ঞানচর্চায় ও সদা অগ্রগামী।’
এদিকে নিঃসংকোচে জীবনের গল্প বলে গেলেন মোস্তাফিজ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে তাকে আবার ছুটতে হবে তিন চাকার বাহন নিয়ে, যার প্যাডেলে ঘোরে ভাগ্যের চাকা।
"