আহমেদ জুনাইদ তন্ময়

  ২২ মার্চ, ২০২৩

শতবর্ষের ইতিহাস ঐতিহ্যে লালিত আনন্দ মোহন কলেজ

‘জ্ঞানের জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও।’ বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার যতগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে সেরাদের তালিকায় রয়েছে ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ। এই কলেজের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কলেজটি ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে এ কলেজে স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তিত হয়। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত আনন্দ মোহন কলেজ বেসরকারি কলেজ ছিল। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে কলেজটি সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং কলেজের নামকরণ করা হয় সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ। এ সময়ে কলেজের বাংলা ও ইতিহাস বিভাগে অনার্স কোর্স প্রবর্তিত হয় এবং কলেজ ভবনকে সম্প্রসারণ করা হয়।

বর্তমান চিত্র

ময়মনসিংহ শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ১৫ দশমিক ২৮ একর জমির ওপর নির্মিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এখানে ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে এবং ২০৭ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা রয়েছেন। কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে আবাসিক হল; ছাত্রদের জন্য বর্তমানে ৩টি ও ছাত্রীদের জন্য ৪টি হল রয়েছে। আরো রয়েছে অধ্যক্ষ ভবন, কর্মকর্তা-কর্মচারী ভবন, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, কম্পিউটার ল্যাব, বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ছাত্রছাত্রীদের জন্য মেডিকেল সেন্টার, ক্যান্টিন ইত্যাদি। কলেজটির বর্তমান অধ্যক্ষের নাম প্রফেসর মো. আমান উল্লাহ। বর্তমানে আনন্দ মোহন কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে তিনটি বিভাগসহ ২০টি বিষয়ের ওপর অনার্স কার্যক্রম চালু আছে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

আনন্দ মোহন কলেজের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সবার আগে যার নাম পাওয়া যায় তিনি হচ্ছেন বাঙালি শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক আনন্দ মোহন বসু। আনন্দ মোহন বসু ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন। পরে ১৮৮৩ সালে এই ইনস্টিটিউশন কার্যক্রম শুরু করে ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল নামে। ১৮৯৯ সালের দিকে ময়মনসিংহের দুটি নাগরিক কমিটি যথা- ময়মনসিংহ সভা ও আঞ্জুমানে ইসলামিয়া একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সমাজসংস্কারক আনন্দমোহন বসুর সহায়তায় ১৯০১ সনের ১৮ জুলাই সিটি কলেজিয়েট স্কুলটি ময়মনসিংহ সিটি কলেজ নামে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। তৎকালীন সময়ে এই কলেজটি কলকাতার সিটি কলেজ কাউন্সিলের আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত হতো। কিন্তু হঠাৎ করেই ১৯০৮ সালে সেই আর্থিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ১৯০৮ সালে ময়মনসিংহ সিটি কলেজ আনন্দ মোহন কলেজ নামে যাত্রা শুরু করে তবে কলেজের শিক্ষাপ্রদান কার্যক্রম শুরু হয় ১৯০৯ সালে। এই কলেজের পুরো জায়গা দান করেন মৌলভী হামিদ উদ্দিন। বর্তমানে তার নামে কলেজে একটি ৫ তালা ভবন রয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালে আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্র ছিল মাত্র ১৭৮ জন ও শিক্ষক ছিলেন ৯ জন। কলেজটি ১৯৪৭ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল পরে নব্বই দশকে কলেজটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের অধিভুক্ত হয়। কলেজটি ১৯৬৪ সালে সরকারীকরণ করা হয়। বর্তমানে কলেজটির বয়স ১১৫ বছর।

অনুষদ ও বিভাগসমূহ

বর্তমানে কলেজটিতে ৪টি অনুষদ ও ২০টি বিভাগ রয়েছে। কলা অনুষদের অধীনে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও ইসলাম শিক্ষা বিভাগ। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজকর্ম, সমাজবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও দর্শন বিভাগ। বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ। ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের অধীনে রয়েছে হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগ।

শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা

আনন্দ মোহন কলেজ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। এই কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৫০ হাজার বই নিয়ে একটি সমৃদ্ধ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, গবেষণাগার, কলেজ ক্যান্টিন, কেন্দ্রীয় মসজিদ, প্রতিটি বিভাগে অসংখ্য বইসহ সেমিনার, মেডিকেল সেন্টার, আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৭টি হল, যার মাঝে ছেলেদের জন্য বর্তমানে ৩টি (নির্মিতব্য ২টি) এবং মেয়েদের জন্য ৪টি আবাসিক হল। এ ছাড়া দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে কল্যাণ তহবিল এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন রোডে চলাচলের জন্য রয়েছে ৩টি শিক্ষার্থী বাস।

ছাত্র সংগঠন

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এক ঐতিহ্যের নাম আনন্দ মোহন কলেজ। এই ক্যাম্পাসে রয়েছে ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।

যারা পড়েছেন ও পড়িয়েছেন

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের অন্যতম বিচারক রাধা বিনোদ পাল ১৯১১-১৯২০ সালে এই কলেজের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ইতিহাসবিদ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম এবং লেখক ড. সফিউদ্দিন আনন্দ মোহন কলেজে শিক্ষকতা করেন। বিগত শতাধিক বছরে এ কলেজে অসংখ্য বিখ্যাত ব্যক্তি অধ্যয়ন করেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- নীহাররঞ্জন রায় (ইতিহাসবিদ), পিসি সরকার (জাদুকর), প্রবোধ চন্দ্র গোস্বামী (শিক্ষাবিদ), প্রিন্সিপ্যাল ইবরাহীম খাঁ (শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক), নুরুল আমিন (পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (ঔপন্যাসিক), আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (কবি), যতীন সরকার (সাহিত্যিক ও গবেষক), হেলেনা খান (শিশুসাহিত্যিক), নির্মলেন্দু গুণ (কবি), ইফ্ফাত আরা (সাহিত্যিক), রাশেদ খান মেনন (রাজনীতিবিদ), মুশাররাফ করিম (কবি ও শিশু সাহিত্যিক), সোহেল রানা (অভিনেতা), প্রফেসর মো. আনোয়ারুল ইসলাম (সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়), ড. অরবিন্দ পোদ্দার (বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক), এম এ রশিদ (বিচারপতি), সত্যপ্রিয় রায় (পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক ও শিক্ষা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা) প্রমুখ ব্যক্তিরা।

সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম ও সংগঠন

আনন্দ মোহন কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রম চালু আছে। কলেজে বিএনসিসি, রোভার স্কাউটস, আনন্দ মোহন কলেজ ডিবেটিং ক্লাব, রক্তদানের সংগঠন বাঁধন, পরিবেশ ক্লাব বাংলাদেশ, সমকাল সুহৃদ সমাবেশ, ফিজিকস ক্লাব, বোটানি ক্লাব, সাংস্কৃতিক পর্ষদ ইত্যাদি। সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোর মাঝে খেলাধুলা, মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য বিতর্ক, কুইজ প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

অর্জন ও প্রাপ্তি

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের র‌্যাংকিং কেপিআইয়ের ভিত্তিতে দেশসেরা কলেজের তালিকায় আনন্দ মোহন কলেজ চতুর্থতম। প্রতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে সেরাদের তালিকায় থাকে ঐতিহ্যবাহী আনন্দ মোহন কলেজ। ৬৩তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের হয়ে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে আনন্দ মোহন কলেজে শিক্ষার্থী তাহজিব হোসেন, সম্প্রতি এটিএন বাংলার ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি বিতর্ক বিজয়ী হয় আনন্দ মোহন কলেজ ডিবেটিং ক্লাব। এ ছাড়া জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক-২০২২-এর রাউন্ড পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হয়েছে আনন্দ মোহন কলেজ শিক্ষার্থী তানজিল আহমেদ। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে জাতীয় পর্যায়ে একক বিতর্কে প্রথম ও ইংরেজি বিতর্কে দ্বিতীয় হয়েছে আনন্দ মোহন কলেজের আরেক শিক্ষার্থী অর্ণব দাস। শতবছর অতিক্রম করা সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ আরো বহুদূর এগিয়ে যাক এই প্রত্যাশা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close