মো.শাকিল আহমদ, চবি

  ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩

যমুনার বুকে এক দিন

ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে। একঘেয়েমি কাটাতে মাঝে মাঝে অবসরে ঘুরতে যাওয়া উচিত। শীতের ছুটিতে বন্ধুরা সবাই গ্রামের বাড়িতে। এই সুযোগে দুরন্ত শৈশবের খেলার সাথীদের নিয়ে হঠাৎ কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা হলো। কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম এবার যমুনার তীরে নৌকা ভ্রমণ ও বালুচরে গ্রামীণ দৃশ্য অবলোকন করব। যেই কথা, সেই কাজ। ঠিক করে ফেললাম ২৭ ডিসেম্বর চলে যাব প্রকৃতির সন্ধানে। উল্লেখ্য, যমুনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর একটি। এটি ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রধান শাখা। এই নদীর বুকেই অবস্থিত উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বারখ্যাত বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু তথা বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু।

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। বাইরে ঘন কুয়াশা। হাড় কাঁপানো কনকনে শীত। বইছে শিশির সিক্ত মৃদু বাতাস। ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৮টা। এখনো পূর্ব দিগন্তে আলোর দেখা মিলছে না। তবু তাড়াহুড়ো করে আমরা সবাই ঘর থেকে বের হলাম। পূর্বনির্ধারিত গাড়ি নিয়ে আমরা চলে গেলাম সোজা জগন্নাথপুর রেলস্টেশনে। রাস্তায় ঠান্ডা আবহাওয়ার দরুণ আমাদের হাত-পা কাঁপছে। প্রচন্ড শীতেও সবার মাঝেই আনন্দের হাসি। কারণ, যমুনার বুকে রোমাঞ্চকর নতুন একটি দিন উপভোগ করতে যাচ্ছি, সেই আশায়। সকাল সাড়ে ১০টায় রেলস্টেশনে পৌঁছে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম ট্রেনের জন্য। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ট্রেন আসল। যেই না প্ল্যাটফর্মে ভেতরে ট্রেন থামল এমনি ঝটপটে ওঠে পড়লাম। উঠেই দেখি হুলুস্থুল কারবার। একে তো পা রাখার জায়গা নেই। তার মধ্যে দেখি কেউ কেউ বাজারে বিক্রি করার জন্য ফলমূল, শাকসবজি, হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। যাইহোক, এরই মাঝে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রেন চলতে শুরু করল আপন ঠিকানায়। বেশ কিছুক্ষণ পর একটি স্টেশনে থামল। অনেক লোক নেমে পড়ল আবার অনেকেই নতুন করে উঠল। কপাল গুনে জানালার পাশে কিছু সিট ফাঁকা হলো। তাড়াতাড়ি বসে পরলাম আমরা কয়েকজন। জানালার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি চলে গেল সবুজ মাঠে। চারদিকে দৃষ্টিনন্দন সরিষা খেত। পূবালী বাসাতে শর্ষের ফুল দোল খাচ্ছে এদিক ওদিক। মৌমাছিরা মধু আহরণ করছে শর্ষের ফুল থেকে। মাঠ পেরিয়ে বিল। ঝাঁকে ঝাঁকে গাং চিল মুক্ত আকাশে ডানা মিলে উড়ছে। সাদা সাদা বক ছোট ছোট মাছ শিকার করছে। জানালার ফাঁকে মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখতে লাগলাম গ্রামের এসব দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। এসব দেখতে দেখতে দুচোখ জুড়িয়ে গেল। হঠাৎ দেখি ট্রেন থেমে গেল বঙ্গবন্ধু রেলস্টেশনে। আমরাও নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। সেখান থেকে যমুনার তীর খুব কাছেই। তাই রিকশা নিয়ে চলে গেলাম যমুনার পাড়ে। ছুটির দিন থাকায় তীরবর্তী এলাকায় দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে।

যমুনার সৌন্দর্য, সূর্যাস্ত ও বঙ্গবন্ধু সেতু দেখার জন্য দর্শনার্থীদের যেন ঢল নেমেছে। ছোট-বড় সব বয়সি মানুষের যেন এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। নদীর দিকে কিছুক্ষণ স্থীর দৃষ্টিতে দেখলাম মন ভরে।

সারি সারি নৌকা বেঁধে রেখেছে ঘাটে। জেলেরা মাছ ধরছেন নদীতে। নতুন রেলপথের কাজ চলছে। এজন্য নদীতে বড় বড় জাহাজগুলো চোখে পড়ছে। নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর আমরা ইঞ্জিনচালিত একটা নৌকা ভাড়া করলাম। মাঝিকে বললাম আমাদের নিয়ে চলেন বঙ্গবন্ধু সেতুর ভেতর দিয়ে। আমাদের কথা মতো মাঝি ভাই চলতে লাগলেন। যমুনার বুকে নৌকা ছুটে চলছে। নদীর প্রকৃতির নিগুঢ় স্বাদ আস্বাদন করতে করতে আমরাও যাচ্ছি সামনের দিকে। খুবই ভালো লাগছে। এই অনুভূতি বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমাদের কারোই এর আগে কখনো এভাবে দলবেঁধে যমুনাতে আসা হয়নি। তাই সবারই বেশ আনন্দ লাগছিল। বেশকিছুক্ষণ পর সামনে দেখা মিলল বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেদু। খুব কাছ থেকে সেতু দেখব এজন্য আনন্দ আরো বেশি লাগছিল। এই মুহূর্তটাকে স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ক্যামেরায় বন্দি হচ্ছে। নৌকা সেতুর ভেতর দিয়ে ছুটে চলল। নদীর ভেতর দিয়ে সামনে যেতে যেতে একটি চরের পাশে থামল নৌকা। আমরা বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করলাম সেখানে। এরপর চলে আসলাম নদীর ঘাটে। নৌকার মাঝিকে বিদায় দিয়ে আমরা চলতে লাগলাম যমুনার চরে গ্রামের দিকে। বালির মাঝে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখতে পেলাম বৈচিত্র্যময় গ্রামের সৌন্দর্য। নিরিবিলি আর সবুজে আচ্ছাদিত এক মনোমুগ্ধকর জায়গা। এখানের দূষণমুক্ত হাওয়াতে তৃপ্তি সহকারে নিঃশ্বাস নিলাম।

কথা বললাম স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। মুগ্ধ হলাম তাদের আতিথেয়তায়। খুবই সাটামাটা মানুষ। মন খুলে কথা হলো তাদের সঙ্গে। বিস্মিত হলাম তাদের সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনে। যদিও এখন আর আগের মতো কষ্ট করে জীবনযাপন করতে হয় না। তবে একসময় নদীর পাড়ের মানুষের ভোগান্তির যেন অন্ত ছিল না। স্থানীয় মাঝ বয়সি এক চাচা আমাদের ঘুরে ঘুরে বৈচিত্র্যময় চরের মাঝে ফসলি জমি দেখাল। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। মাঠভরা সরিষা খেত। অনেকেই আবার সরিষা খেতে মধু চাষ করছে। দেখলাম বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির খেত। বিশেষ করে সাড়ি সাড়ি ভুট্টা, মটরছোলা, মিষ্টি আলু, চিনাবাতাম প্রভৃতির খেত। এসব হরেক রকমের দৃশ্য দেখতে দেখতে শরীরে ক্লান্তি আসলেও মন খুবই প্রফুল্ল। এদিকে পশ্চিমাকাশে রক্তিম সূর্য ডুবতে চলেছে। ফিরতে হবে নীড়ে। তাই আর দেরি না করে কাছেই একটি বাজার ছিল, সেখানে চলে আসলাম। সেখান থেকে গাড়িতে করে চলে আসলাম বঙ্গবন্ধু রেলস্টেশনে। এরপর সিএনজি রিজার্ভ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। এভাবেই একটি দিন কেটে গেল খুবই প্রফুল্ল চিত্রে। সত্যি স্মৃতি হয়ে থাকবে এই উৎসবমুখর দিনটি। এরকম চমৎকার দিন জীবনে বারবার আসুক এমনটাই প্রত্যাশা। আর হ্যাঁ, চাইলে আপনারাও এই মনমুগ্ধকর গ্রামীণ দৃশ্য উপভোগ করতে চলে আসতে পারেন যেকোনো মুহূর্তে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close