সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক, বেরোবি

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩

গণিত সত্য প্রকাশের অনন্য সৌন্দর্য

গণিত কেবল সত্যই প্রকাশ করে না। এর মধ্যে রয়েছে অনন্য সৌন্দর্য। আর এই সৌন্দর্যকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং গণিতের ভীতি দূর করতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) শিক্ষার্থী ওবায়দুর কনক নিজ উদ্যোগে চার শতাধিক শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে গণিত শিক্ষা দিয়ে আসছেন। কনক বলেন, আমি এ কাজ বিগত পাঁচ মাস ধরে করে আসছি। আমি মনে করি, নিজের ভাই-বোনদের পড়ালে যেমন কেউ মূল্য নেয় না, ঠিক তেমনি আমিও সবাইকে গণিত পড়াই ভ্রাতৃত্বের টানে, টাকার জন্য নয়। এ জন্য আমি কারো কাছে কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করি না।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থী গণিতপ্রেমী ওবায়দুর কনক। তিনি পাঁচ মাস ধরে বেরোবি ক্যাম্পাসের খোলা আকাশের নিচে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিনা পারিশ্রমিকে প্রতি রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার গণিত পাঠদান করে আসছেন। তার এই উদ্যোগ বেরোবি শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস তার।

ক্লাসে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরাও বেশ আনন্দিত কনকের এমন উদ্যোগে। জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মোত্তালেব হোসেন বলেন, ‘আমি ওবায়দুর কনক ভাইয়ের গণিত ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থাকি। এর মাধ্যমে আমি অনেক উপকৃত হচ্ছি। তার শেখানোর ধরন অনেক সহজ ও প্রাণবন্ত। আমি মনে করি, ভাইয়ের গণিত ক্লাস যদি কেউ নিয়মিত করে, তার গণিতের ভীতি অনেকটাই দূর হবে, ইনশাআল্লাহ।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া পারভীন বলেন, ‘কনক ভাইয়ার গণিত ক্লাসের নিয়মিত সদস্য আমি। নিয়মিত হওয়ার পেছনে একটি গল্প আছে। আমার কাছে শুরু থেকেই গণিত একটি ভালো লাগা ও আগ্রহের জায়গা। তাই আমি চেয়েছিলাম একজন দক্ষ ব্যক্তির সান্নিধ্যে গণিতের চর্চা করতে। এ উদ্দেশ্যেই আমি ভাইয়ার কাছে প্রথম ক্লাস করতে যাই এবং এখন নিয়মিত প্রতিটি ক্লাস মনোযোগ সহকারে করি। তার শেখানোর পদ্ধতি অত্যন্ত চমৎকার, যা আমার গণিতের বড় বড় সমস্যাগুলো খুব দ্রুত সমাধান করতে সাহায্য করছে। তার এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।’

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে ওবায়দুর কনক ভাইয়ের মহৎ উদ্যোগের কথা জানতে পারি। গণিতের প্রতি ভয় অনেক আগে থেকেই কাজ করত। ফলে ভালোভাবে গণিত শেখার সাহস করা হয়নি কখনোই। কিন্তু এখন তো জব প্রিপারেশনের জন্য করতেই হবে। তাই কোনো কিছু না ভেবেই গেলাম ভাইয়ার ক্লাসে। এখন ভাইয়ার গণিত ক্লাস নিয়মিত করি। তার ক্লাসের মাধ্যমে আমার গণিতের ভীতি দূর হচ্ছে। নতুন নতুন অনেক অজানা বিষয়ে জানতে ও বুঝতে পারছি, আলহামদুলিল্লাহ।’ আনুসরের মতে, যদি কেউ কনক ভাইয়ার প্রতিটি গণিত ক্লাস করে, তার গণিত ভীতি দূর হবে, ইনশাআল্লাহ।

তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নবাজ কনক বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই-বোনদের গণিত শিখতে উৎসাহিত করা, যাতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই গণিতে তাদের মোটামুটি ধারণা তৈরি এবং তাদের ভেতরের গণিত ভীতিটা দূর করা। এই প্ল্যাটফর্ম আমি তৈরি করে দিয়ে গেলাম। কিন্তু এটা ধরে রাখার দায়িত্ব বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। হয়তো আমার জব হলে আমি চলে যাব। কিন্তু আমার জায়গায় অন্য আরেকজন স্বেচ্ছাসেবী এসে গণিত শেখানোর এ ধারা অব্যাহত রাখবে। সেটাই আমার প্রত্যাশা। এভাবেই এক দিন ক্যারিয়ারভিত্তিক বড় সেবামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে উঠবে এটি, যার সুফল ভোগ করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।’

তার ধারণা, একটা সময় দেখা যাবে, বেরোবির শিক্ষার্থীরা সব জায়গায় তাদের মেধার সাক্ষর রেখে জব সেক্টরে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করবে। ‘মূলত এটিই আমার উদ্দেশ্য,’ বলছিলেন কনক।

মনোরোগবিদরা বলছেন, গণিত ভীতি একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক সমস্যা। এ সমস্যায় ভুক্তভোগী ব্যক্তি গণিতে যে ভালো করতে পারেন, এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। এছাড়া ভয়ের কারণগুলোকে ভেঙে সমাধানের সূক্ষ্ম উপায় বের করার কথাও বলছেন মনোরোগবিদরা।

গণিত ভীতি দূর করার উপায়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমে শিক্ষার্থীকে গণিতের প্রতি আগ্রহী করতে হবে। তার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। গণিত মুখস্থ করার কোনো বিষয় নয়। তবে সূত্র মুখস্থ করা যেতে পারে। অবশ্যই গণিত বুঝতে হবে। বুঝে নিয়ে গণিত চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু পাঠ্যবই কেন্দ্রিক না করে ধাঁধা, কুইজ, সুডোকু, পুলসাইড পাজল, দাবা, বোর্ড গেম, রুবিকথস কিউব বা গণিতের নানা ধরনের অনলাইন খেলার সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে শিক্ষার্থীদের। এসব খেলা মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে তোলে। গণিত নিয়ে অনেক মজার মজার বই রয়েছে, অনলাইন প্রবন্ধ রয়েছে, সেগুলো পড়া যেতে পারে। বিভিন্ন ছবি, ইলাস্ট্রেশন, ভিডিও, এনিমেশনের মাধ্যমেও অঙ্ক শেখাটা অনেক সহজ হতে পারে বলেও মত তাদের।

গণিতে দক্ষ বেরোবি শিক্ষার্থী কনকের মতে, বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিল রেখে যদি গণিত শেখানো হয়, এটি বেশি মনে থাকে। শুরুতে গণিতের জন্য সময় বেঁধে না দিয়ে নিজের মতো লম্বা সময় ধরে শিখতে উৎসাহিত করুন। প্রথমে সময় বেশি লাগলেও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। সবচেয়ে ভালো হয়, অল্প কয়েকটা সহজ অঙ্ক দিয়ে শুরু করা। এতে আগ্রহ বাড়বে। অনেকে অঙ্ক করার আগেই উত্তরপত্র দেখে নেন। এটা অনেকটা নিজেকে ঠকানোর মতো কাজ। উত্তর না দেখে আগে যাচাই করুন। ভুল থেকেই শেখা হবে। নামতার হিসাব কীভাবে হলো, সূত্রগুলো কীভাবে এলো, এগুলো যাচাই করলে, মনে রাখা সহজ হবে। সব সময় ক্যালকুলেটর বা গুগল নির্ভর না হয়ে, ছোটখাটো হিসাব মাথায় সেরে নেওয়ার চেষ্টা করুন। তবে অঙ্কের ভীতি দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত অনুশীলন। প্রতিদিন অল্প হলেও অঙ্ক করার অভ্যাস করলে আস্তে আস্তে এতে পারদর্শী হওয়া সম্ভব।

গণিতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হলেন একজন ভালো শিক্ষক। এছাড়া যাদের গণিতে আগ্রহ রয়েছে। তারা অন্যদের ভীতি দূর করতে এগিয়ে আসতে পারেন। নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে গণিত বিভাগে অধ্যয়নরত আইনার স্কালভিক বলেছেন, গণিতের ভীতি কাটাতে সব শিক্ষার্থীর ক্লাসে মন খুলে কথা বলা বা প্রশ্ন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, গণিত ভীতিতে থাকা শিক্ষার্থীরা অন্যদের সামনে ছোট হওয়ার ভয়ে থাকেন এবং কোনো প্রশ্ন করে না। ভুল করাটা শেখার প্রক্রিয়ার একটি অংশ। তাই লজ্জা, আর ভয় জয় করে গণিত শিখতে হবে বলে মত তরুণ গণিতবিদ কনকের।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close