সোনিয়া আক্তার. ঢাবি

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৩

যারা আমার স্বপ্নযাত্রার সারথি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তনের দিনটি আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ও আমৃত্যু সৃতিরোমন্থন করার মতো দিন। সেদিন আমি রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর আবদুল হামিদের কাছ থেকে দুটি স্বর্ণপদক যথাক্রমে শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমদ স্বর্ণপদক ও মিসবাহউদ্দিন খান স্মৃতি স্বর্ণপদক গ্রহণ করেছি। একইভাবে ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বরের দিনটিও ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এই দিন ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য কলা অনুষদের পক্ষ থেকে আমাকে ‘একাডেমিক রিকগনিশন’ ডিন’স অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। সবকিছুর জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। সত্যি বলতে আমার কাছে অর্জন মানেই একটা মিশ্র অনুভূতি, যেখানে পাড়ি দিতে হয়েছে কণ্টকাকীর্ণ, বন্ধুর শত সহস্র মাইল আবার কখনো সুশোভিত মসৃণতায় ভরপুর। জীবন চলার পথে এমন কিছু সুন্দর, আনন্দঘন, উচ্ছ্বসিত মুহূর্ত আসে যাকে না কোনো শব্দগুচ্ছে প্রকাশ করা যায়, না কোনো সজ্ঞায় সজ্ঞায়িত করা যায়। আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে তিতাস নদীর তীর ঘেঁষে অনিন্দ্য সুন্দর কৃষ্ণনগর গ্রামে। ছোটবেলায় ভীষণ রকমের দুরন্ত আর চঞ্চল স্বভাবের থাকায় মা আমাকে নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকতেন এই ভেবে যে নিশ্চয়ই কোথাও কোনো ঝামেলা বাঁধিয়ে এসেছি। আমার প্রথম শিক্ষক, যার হাতে আমার হাতেখড়ি শ্রদ্ধাভাজন প্রিয়তম মানুষ নানী মমতাজ বেগম, যিনি ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। এ মানুষটির কাছে আমি অসংখ্য গল্প শুনেছি। কখনো কখনো নানা গল্পের ছলে তিনি আমায় ঘুমও পাড়াতেন। আজ এসব ভীষণ মিস করি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমার নানীর মতো অসংখ্য মানুষ আমার স্বপ্নবুননে সারথী হয়েছেন। ২০১৪ সালে কৃষ্ণনগর আবদুল জব্বার উচ্চবিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া এবং কুমিল্লা বোর্ডে মানবিক বিভাগে ১২তম স্থান অধিকার করার স্মৃতি আজও অমলীন। এসএসসির ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার দিনটি আমার কাছে এখনো জীবন্ত আর সজীব মনে হয়। বাবা-মা ও শিক্ষকরা বলতেন সোনিয়া তোমাকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। আমি জানি, সে স্বপ্ন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শিশিরের কণার মতো হারিয়ে যাওয়ার নয়। তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশা পূরণের তাড়নায় জায়গা করে নিয়েছিলাম স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হলাম পছন্দের বিষয় ইতিহাস বিভাগে। খুব সম্ভবত ২০১৭ সালের জানুয়ারির দিকে, স্যাডোতে চা খেতে খেতে চোখে পড়েছিল রংবেরঙের সø্যাশ পরিহিত কিছু অগ্রজের উচ্ছ্বসিত মুখ। মনে প্রশ্ন উঁকি দিয়েছিল তারা কেন এমন পোশাক পরেছে। পরে জেনেছিলাম তারা ভালো ফলাফলের স্বীকৃতিস্বরূপ এসব পোশাক পরার অধিকার অর্জন করেছে। সে দিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমিও এসব পড়তে চাই। পূর্ণতার গল্পটা ধরা দিল ২০২২ সালে এসে। ডিন’স অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে বাবা-মাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মা-বাবার সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া স্নেহের ছোট বোন মুন্নি আক্তারও এসেছিল সেদিন। একদিকে অভিভাবকদের সারিতে বসে আছেন বাবা-মা, অন্যদিকে অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সারিতে আমি। পুরো অনুষ্ঠানে বাবা-মার সঙ্গে সামনাসামনি কোনো কথা হয়নি আমার। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি তারা বারবার আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমিও প্রাণভরে তাকিয়ে ছিলাম। এ এক অন্যরকম ভাষা, যেখানে কোনো শব্দের ব্যবহার নেই, নেই কোনো ব্যাকরণিক নিয়মনীতি। তবু আমরা বুঝে গেছি, তখন কী ভালো লাগা অনুভব করছিলাম। তাদের দৃষ্টিজুড়ে যেন গর্ব আর সার্থকতার বহিঃপ্রকাশ। চোখের ভাষা বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আর বহুল ব্যবহৃত ভাষা। অনুষ্ঠান শেষে আমার পিতা-মাতার চোখণ্ডমুখ লেগেছিল তৃপ্তির হাসি। এক জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কি-ই বা চাওয়ার থাকে। যেসব সম্মানিত শিক্ষক, অগ্রজ-অনুজ আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে সাহস জুগিয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। সবার স্নেহ ভালোবাসায় আমি সিক্ত। দিনশেষে একজন ‘মানুষ’ হিসেবে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ মানবিক মূল্যবোধের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আত্মপরিচয় তৈরি করা এবং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করাই জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। সবার নিকট দোয়াপ্রার্থী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close