মো. ইয়াছিন আরাফাত, ইবি

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২৩

কুয়াকাটার সাগরকন্যায় এক দিন

অনার্স প্রথমবর্ষের ক্লাস, প্রেজেন্টশন, টিউটোরিয়াল, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিতে দিতে বন্ধুরা যখন সবাই হাঁপিয়ে উঠেছিল। ঠিক তখনই বন্ধুদের উদ্যেগে, শিক্ষকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হলো এক জমকালো বার্ষিক শিক্ষাসফরের। সফরের স্থানটি ছিল ঐতিহাসিক কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে। যার কথা শুনলে সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। অধীর আগ্রহে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। হৃদয়ের মাঝে হাজারো চিন্তার বীজ বুনে আমি কি সেথায় কখনো যেতে পারব? দেশের প্রান্তিক লেভেল থেকে উঠে আসা বন্ধু ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা সফরে যাওয়ার বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছানো সত্যিই কঠিন ছিল। কিন্তু দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ওইদিন ১৪ ডিসেম্বর সত্যিই সাগরকন্যার সাক্ষাতে উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা ইবির আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের একঝাঁক মেধাবী তরুণ।

বিকাল গড়িয়ে আকাশের বুকচিরে যখনই নেমে এসেছিল সন্ধ্যা, ঠিক তখনই শুরু হয়েছিল আমাদের কাঙ্ক্ষিত সফরযাত্রা, কুয়াকাটা মিশন। গাড়িতে আরোহণ করার পর আমাদের সম্মানিত স্যার, প্রফেসর ড. শামসুল হক সিদ্দিকী, আমাদের নিরাপদ সফরের উদ্দেশ্যে, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান এবং যানবাহনে আরোহণের ও দোয়া পাঠ করিয়ে নিয়েছিলেন।

আমরা খুব দ্রুতই রওয়ানা হয়েছিলাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া থেকে। কারণ কুয়াকাটার মূল আকর্ষণই হচ্ছে সূর্যোদয় দেখা। রাতে ভারী ধরনের খাবার না খেয়ে হালকা নাশতার সুন্দর ব্যবস্থায় রাত্রি কাটানো হলো আমাদের সবার। রাত সাড়ে তিনটায় আমরা পৌঁছে যাই বহুল প্রত্যাশিত কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের কোল ঘেঁষে অবস্থিত আবাসিক রিসোর্টে। ঘণ্টাখানেক রিসোর্টে অবস্থানের পর সালাতুল ফজর আদায় করে আমরা রওয়ানা হয়ে যাই মোটরযান চালিত রিকশায় জনপ্রতি ৮০ টাকার ভাড়ায়, ৪৫-৫০ মিনিটে ‘গঙ্গামতি সূর্য উদয়’ স্থানে। ওই অঞ্চলের আবহাওয়া প্রতিকূল থাকার কারণে আমাদের ওই দিনের সূর্যোদায় দেখার স্বাদ মিলে একটু দেরিতে, ৬:৫০ মিনিটে। সূয্যিমামার উদয় দেখে আমাদের বন্ধুরা খুবই আনন্দে উচ্ছ্বসিত ছিল। যা মূখের ভাষায় বলে প্রকাশ করা যায় না। বহৃুরা সবাই নিজেদের ইচ্ছার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে সূর্যের ঝলমল আলোকে ক্যামেরা বন্দি করে নিতে একটু ও বিলম্ব করলো না নিজেদের নামি-দামি স্মার্টফোনগুলোতে। কিছুক্ষণ সূর্যের ঝিকিমিকি কিরণকে আলিঙ্গন করে আমরা পুনরায় রিসোর্টে ফিরে আসি। আবার কিছুসময় বিশ্রাম নেওয়ার পর সবাই নিজেদের জামা-কাপড় পরিধান করে একত্রে নাশতা করতে যাই।

ডিমণ্ডখিচুড়ি ভাতের হালকা নাস্তা সেরে সবাই রওয়ানা হই সমুদ্রের পাড়ে। সমুদ্র সৈকতের উত্তাল জলরাশির ঢেউ দেখে আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ কবি কবি ভাব নিতে শুরু করেছিল। সবাই মনপ্রাণ উজাড় করে গান-গজল গাইতে শুরু করেছিল। এদিকে আমাদের শিক্ষা সফরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল।

বাজার থেকে ভাড়া করা দুটি সাউন্ড বক্স, সাথে তৈরি করা শিক্ষা সফরের রঙিন ব্যানারটাও নিয়ে আসা হলো সমুদ্র তীরে। সাউন্ড বক্সগুলোর ব্যাটারির লাইন সংযোগ ও দুটি বাঁশের মাঝে আটকানো হলো সফরের জন্য প্রস্তুত করা ব্যানারটি। তার পর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মূল কার্যক্রম।

সম্মানিত স্যার প্রফেসর ড. শামসুল হক সিদ্দিকীর তত্ত্বাবধানে আরম্ভ হলো আমাদের জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিল পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত ও ইসলামি সংগীত। তারপর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। এগুলোর মধ্যে ছিল কুরআন তেলাওয়াত, হামদণ্ডনাত, দেশাত্মবোধক গান, স্বরচিত কবিতা পাঠ, নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর অভিনয়, হাঁড়িভাঙা খেলা এবং ফুটবল ম্যাচের আয়োজন। আমার বন্ধুরা যে প্রত্যেকে দারুণ প্রতিভাবান তা জানা ছিল না। বিশেষ করে ওইদিন প্রিয় বহৃু আজাদ হোসেনের স্বরচিত কবিতা ‘কুয়াকাটা সফর’ কবিতাটি ছিল দারুণ। কবিতাটি নিম্নরূপ -

সমুদ্র, অরণ্যে জলে জঙ্গলে

সময় কাটুক আনন্দ কোলাহলে

নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের আধার সমুদ্রকন্যা তীরে

চল চল বন্ধগণ যাই, আসি ঘুরে

ইবি থেকে আমরা যাচ্ছি শিক্ষা সফর

সাথে আছেন সামছুল হক সিদ্দিকী স্যার।

কুয়া থেকে কুয়াকাটা, ইতিহাস থেকে পাই

সূর্যি উদয় অস্ত দেখতে চলো সমুদ্রতটে যাই।

সাংস্কৃতি খেলাধুলা নানা বিনোদনে

স্মরণীয় হয়ে থাকুক গেঁথে থাকুক মনে

অর্জিত হোক জ্ঞান এই সফর ঘিরে

ভালো থেক কুয়াকাটা আবার আসব ফিরে।

তারপর শুরু হলো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, এর দুটি এজেন্ডা ছিল, প্রথমটি হাঁড়ি ভাঙা খেলা, দ্বিতীয়টি ফুটবল ম্যাচ। হাঁড়ি ভাঙা খেলায় ৫৪ জনের কেউ না পারলেও ২ জন ঠিকই ভাঙতে পেরেছিল, যাদের অবদানে ওই খেলা সফলতার মুখ দেখেছিল। সর্বশেষ ছিল ফুটবল ম্যাচ। ওই ম্যাচের খেলোয়াড় বাছাই হয়েছিল ক্লাসে রোল নম্বর জোড় আর বিজোড়ের মাধ্যমে। বিজোড়ে থাকা দলটির খেলোয়াড়রা খেলার দিক থেকে কম পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও অবশেষে টাইব্রেকারে তারাই বিজয়ী হয়েছিল।

এদিকে বন্ধুদের সবাই সবার জায়গা থেকে ভালো পারফরম্যান্স করায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত প্রাণবন্ত এবং উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হয়েছিল।

এরপর, ঘড়ির কাঁটায় ঠিক যখন ১২:৩০, ঠিক তখনই আরম্ভ হয়েছিল সফরের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ সমুদ্রের লবণাক্ত উত্তাল ঢেউয়ে সাঁতার আর গোসল। ঘণ্টাখানেক খুব উচ্ছাসে সাগরের লবণাক্ত পানিতে হাবুডুবু খায়। আনন্দঘন পরিবেশে সমুদ্র গোসল শেষে সবাই ফিরল রিসোর্টে।

সালাতুল জোহর আদায় করে দুপুরের খাবার গ্রহণ শেষে সবাই বেরিয়ে পড়ল অবশিষ্ট স্পটগুলো দেখার জন্য। বিকালে আমরা চলে গেলাম শুঁটকি পল্লী, তিন নদীর মোহনা, সুন্দরবনের পূর্বাংশ, লাল কাঁকড়ার চর এবং ঝাউবন দেখার জন্য। সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম তিন নদীর মোহনায়, যেটি ছিল সফরের মন কাড়ানো এক মুহূর্ত।

সূর্য ডোবার পরপরই ফিরে এলাম জিরো পয়েন্টে, সেখানে সালাতুল মাগরিব আদায় করে বন্ধুরা সবাই মিলে ঘণ্টা দুয়েক রকমারি দেশি-বিদেশি জিনিসপাতি ক্রয় করলাম। রাখাইন মার্কেট থেকে কেনাকাটা ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কেনাকাটা সেরে সবাই আবার ফিরে এলাম রিসোর্টে, এবার সবাই সালাতুল এশা আদায় করে ব্যাগপত্র, জামাকাপড় গাড়িতে তুলে নিলাম, আর শেষবারের মতো সফরের খাবার-দাবার সেরে নিলাম মুরগির মাংসের বিরিয়ানি দিয়ে। সবাই তৃপ্তি ভরে উদরপূর্তি করে গাড়িতে উঠে পড়লাম।

শুরু হলো সফরের ইতিটানা। বাসে উঠার খানিক পরেই শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পুরস্কার বিতরণ, বন্ধুদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আমি জিতে নিলাম কুরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় স্থান। পুরস্কার হাতে পেয়ে ছিলাম খুবই উৎফুল্ল আর বিচলিত। পুরস্কার বিতরণ শেষে সবাই দিনের বেলায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দৃশ্যের প্রশংসায় মেতে উঠলাম। গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল গন্তব্যের উদ্দেশে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close