সবুর খান

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০২২

বেরোবির বুকে মানুষের ঢল

পশ্চিমাকাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বক্ষণে বিস্তীর্ণ রংপুরের স্থায়ী ও অস্থায়ী বাসিন্দা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই অবসর কাটানোর জন্য যে জায়গাটায় ভিড় জমায় তা কোনো পর্যটন কেন্দ্র কিনা সেটা দেখে কেউ ভুলও করতে পারেন। সবুজ বনঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর পরিবেশ নিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থানরত যে পর্যটন কেন্দ্রের কথা বলছি তা কোনো পর্যটন কেন্দ্র নয়, সেটি বৃক্ষের জাদুঘর খ্যাত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

ইতিহাস পড়ে জেনেছি, ইউরোপের বাতিঘর ছিল কর্ডোভা নগরী। খলিফা আল-ওয়ালিদের সময় এই নগরী শিক্ষা-সংস্কৃতিতে এতটাই উৎকর্ষ লাভ করেছিল যে, সমগ্র ইউরোপ যখন বর্বর, অজ্ঞতা ও দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত, এ রাজ্য তখন পাশ্চাত্যের সম্মুখে উজ্জ্বল আলো বিকিরণকারী জ্ঞান ও সভ্যতার মশাল তুলে ধরেছিল। ঠিক একইভাবে, উত্তরাঞ্চলের বাতিঘর হয়ে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে প্রতিনিয়ত জ্ঞানের দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

ছুটির দিনে বিশেষত শুক্রবারে শত শত মানুষের ঢল নামে বেরোবি ক্যাম্পাসের বুকে। যুবক থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। মূলত ছুটি কাটানো ও পরিবেশ উপভোগ করার জন্য এমন মানুষের ঢল নামে। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন জনসমুদ্রের ঢেঊ এসে রেবোরির ক্যাম্পাসের পাড়ে আছড়িয়ে পড়েছে। বেরোবির মূল প্রবেশ পথ অতিক্রম করলেই চোখে পড়ে সৌন্দর্যমন্ডিত কৃষ্ণচূড়া সারিবদ্ধ ঘেরা এক দৃষ্টিনন্দন রাস্তা যা কৃষ্ণচূড়া রোড নামে পরিচিত। গাছগুলো এতটাই ছায়াময় ও মায়াময় যে পুরো ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে অন্তঃসলিলা নদীর মতো বুকে ধারণ করেছে। কৃষ্ণচূড়া রোড়ের একপাশে বেরোবির সেন্ট্রাল ফিল্ড ও আরেকপাশে স্বাধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য অদম্য ও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে বিজয় স্মারক। এই বিজয় স্মারকে বসে রচিত হয় হাজারো শিক্ষার্থী নব্য বিজয় ও পরাজয়ের গল্প।

বিজয় সড়ক ধরে যাওয়া-আসার সময় প্রকৃতিপূজারীরা আলোকচিত্র নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়। কারণ বৃষ্টিস্নাত এই সড়কটি দেখলে আপনার উপলব্ধি হতেই পারে যে আপনি বোধহয় শ্রীলঙ্কার ডাম্বুলা শহরের সিজিরিয়া গার্ডেনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন। এই সড়কের শৈল্পিক কারুকার্য আপনাকে কবি জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতার কয়েকটি লাইন মনে করিয়ে দেবে।

গ্যারেজ রোডের দুধারে ঢেউখেলানো পাহাড়ি পরিবেশ দেখে ছুটে আসা প্রকৃতিপ্রেমী মানুষগুলো শুধু যে অবাক তা নয়, বরং তারা পুরো ক্যাম্পাসের মধ্যে এমন মনোহরী দর্শনীয় স্থান হয়তো দ্বিতীয়টি কল্পনা করে না। দেবদারু রোডের দুপাশে সারিসারি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আপাদমস্তক কিশলয়ে ঘোমটা দেওয়া চিরচেনা দেবদারু গাছ। এখানে গাছের সমারোহ মানুষের ডেকে আনে যেন বলে এসে দেখে যাও এই অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ক্যাফেটেরিয়া ছাড়িয়ে এসে সবার ঊর্ধ্বে চোখে পড়ে শান লাগানো বট গাছ। এখানে এসে ভিড় জমায় এই ভেবে যে অন্তত বটবৃক্ষের তলে প্রশান্তি মিলবে যেখানে ঘুচে যাবে সারাদিনের ক্লান্তি। যেসব দর্শণার্থীরা এই বেরোবি ক্যাম্পাসে গৌধূলী লগ্নে সপরিবারে আসে, দেখা যায় ছোট শিশুরা তাদের বাবা মায়ের সামনে মুক্ত পাখির মতো দৌড়াদৌড়ি করছে। তারা বেশ খুশি এই শহরের বিষাক্ত অক্সিজেন থেকে বের হয়ে নতুন বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসতে পেরে। প্রকৃতির সরলতার মাঝে আরেক সরলতার প্রতীকী চিত্র এই নিষ্পাপ শিশুগুলো।

জনসমাগমের পেছনের যে ইতিহাস সেটা বেরোবি ক্যাম্পাসে ৩৮ হাজার বৃক্ষরাজি। এখানে, দেশি-বিদেশি গাছের যে সমারোহ তা বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কিনা তা আমার জানার বাইরে। এই বৃক্ষরাজি, অনন্য নৈসর্গিক পরিবেশ মানুষের ডেকে আনে এই ক্যাম্পাস উপভোগ করার জন্য।

এতকিছু জেনে আপনার মন নিশ্চয় আকৃষ্ট হচ্ছে। তবে আসুন এই বেরোবির মুক্ত করিডোরে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে মিশে যায় প্রকৃতির মাঝে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close