ইসমাইল হোসেন রাহাত, ইবি

  ২৩ নভেম্বর, ২০২২

গ্রামীণ ঐশ্বর্যের লীলাভূমি শ্রীরামপুরে এক দিন

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) টিএসসিসি প্রাঙ্গণে নিস্তেজ হয়ে বসে আছি। হঠাৎ মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল শ্রদ্ধেয় অগ্রজ মুসা হাশেমি ভাইয়ের ম্যাসেজ, হকচকিয়ে ম্যাসেজটি পড়ে ফেললাম! ভাই লিখেছেন, তুমি কি আমাদের সঙ্গে শ্রীরামপুরে যাবে? আমি পুলকিত হলাম, আর চিন্তা করলাম ভাইয়ের সঙ্গে কখনো কোনো ভ্রমণে যাইনি এ সুযোগ অবশ্যই লুফে নিতে হবে! যেই কথা, সেই কাজ রাজি হয়ে গেলাম। রাতে বন্ধু খালিদকে এক পর্যায়ে জোর করে রাজি করালাম। যেতে হবে আমাদের সঙ্গে শ্রীরামপুরে, যেখাসে পক্ষীকূল সাঁতার কাটে মৃত্যু গঙ্গায়।

ভ্রমণ শব্দে লুকায়িত থাকে হাজারো আনন্দ, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, কবিতার পঙক্তি ও লেখকের কলম। বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) সকালে বেড়িয়ে পড়তে হবে, তাই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছি। সকালে উঠে ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি সেলফ ডিফেন্সের কর্মশালায়। সেখান থেকে ভাই ভ্রমণ পিপাসুদের দিকনির্দেশনা ও কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। সেখান থেকে রুমে এসে গোসল করে অলস খালিদের রুমে যাই। সেখান থেকে আমরা ঘড়ি ধরে যথাযথ সময়ে বেড় হয়ে পড়ি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) সেলফ ডিফেন্স ক্লাবের আহ্বায়ক মুসা হাশেমি ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা শেখপাড়া (বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন) বাজার থেকে ইলেকট্রনিক ভ্যানে শ্রীরামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। যাত্রা পথে আনন্দ, হইহুল্লোড় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলে গেলাম শ্রীরামপুর।

ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ত্রিবেণী, মির্জাপুর ও দিগনগর এই তিন ইউনিয়নের মিলনস্থল শ্রীরামপুরে কালীগঙ্গা নদীর উপর দিয়ে গ্রামীণ কারুকার্যে নির্মিত কাঠের সেতু। সেতুটি গ্রামীণ কারুশিল্পের ঐতিহ্য ও গ্রাম্য মানুষের দূঃখ দুর্দশার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে রাস্তা দুই পাশে গাছের সারি প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাবে যে কেউই। মাটির রাস্তা যেখানে বিলুপ্তির পথে, সেখানে গ্রামীণ ঐশ্বর্যের ছোঁয়া ছড়াচ্ছে শ্রীরামপুরের মাটির রাস্তা। দর্শনার্থীদের সুবিধায় নিজ উদ্যোগী হয়ে এলাকাবাসী অলাভজনক বিশ্রাম বিলাস, বট বৃক্ষের ছায়ায় আড্ডা চৌকি, পাখির বাসার নিচে দৃষ্টিনন্দন বৈঠকখানা, নামাজের স্থান ও ভ্রমণ পিপাসুদের খাবার রান্নার জন্য আদর্শ চুলা তৈরি করে রেখেছেন।

আমাদের রান্নার সরঞ্জাম রেখেই দলবেঁধে দুপুরের খাবারের আয়োজনে লেগে যাই। ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে আমাদের রান্নার প্রস্তুতি সম্পন্ন। রান্না করেন জিয়া ভাই, তার রান্নার হাত অসাধারণ। বর্ণনা করা হলে অনেকেই তার থেকে জোর করে রান্না করিয়ে খেতে আগ্রহী হয়ে উঠতে বাধ্য হবেন, তাই থেমে গেলাম। আমি চাই না, অন্য কেউ এমন সুস্বাদু খাবার ভক্ষণ করেন!

প্রযুক্তির অপব্যবহার করতে আমরা কোনো দ্বিধা করি না, কোনো নান্দনিক স্থানে গেলেও হাতে বেড়িয়ে আসে মোবাইল। ঢুকে যাই সোশ্যাল জগতে। অথচ প্রকৃতির কাছে গিয়েও তাকে উপভোগ করি না। কিন্তু শ্রীরামপুর যেন তার থেকে আলাদা, এই লোকালয়ে ইন্টারনেট স্পিড খুবই দুর্বল। তাই সহজেই প্রাকৃতিক ও গ্রামীণ নান্দনিক দৃশ্যাবলি অবলোকন করা যায়। আমরাও তার থেকে আলাদা না হয়ে মিশে গিয়েছিলাম গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে, হারিয়ে গিয়েছিলাম প্রকৃতির মাঝে। মানুষগুলো সহজ-সরল তো বটেই, এছাড়া খুবই অতিথিপরায়ণ ও সবাইকে আপন করে নেয় সহজে।

কালীগঙ্গা নদী মৃতু প্রায়, তাতেও পাখিগুলো নেচে ধুলে ডানা ঝাপটিয়ে গোসল করে, রোদে উড়ে শরীর শুকিয়ে নেয়। পাখিরা খেলা করে সবুজ শ্যামল মাঠে, আহরণ করে শস্যের দানা, গান গায় মিষ্টি সুরে।

দুপুরের খাবার প্রস্তুত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের সময় কাটে প্রকৃতির মাঝে গান গেয়ে গেয়ে। জোহরের নামাজ পড়েছি কাঠের তৈরি ছোট্ট নামাজ ঘরে, মনে হয়েছিল এখানেও লুকিয়ে রয়েছে গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য।

‘যত্রতত্র স্থানে ফেলব না ময়লা, আমার ময়লা আমি রাখব নিরাপদ স্থানে’ এই স্লোগানকে ধারণ করে আমরা প্রকৃতি দূষণকারী ময়লা আবর্জনা ও প্লাস্টিক দূরীকরণে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাই, গ্রামের মানুষ খুশি হয়ে ময়লা ফেলানোর বস্তা দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করে।

ক্যাম্পাসে থাকাকালীন দুপুরের খাবারের কথা স্মরণে খুব কমই আসে। কিন্তু আজ রান্নার অনন্য আয়োজন দেখে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম কখন খাবার প্লেট আসবে আর আমি গলাধঃকরণ করব। চিন্তার এক মূহূর্তে খাবারের ঘণ্টা বাজল, অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। আমরা সবাই হাত ধুয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে বটবৃক্ষের ছায়ায় বাঁশের তৈরি চৌকিতে গোল হয়ে বসে গিয়েছিলাম। অসাধারণ তরকারির সমাহার, গোস্তো ও ঢালের স্বাদ ছিল অসাধারণ। সর্বশেষ ছিল দধি, রাজকীয় খাবার শেষে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হয়।

শীতের বিকাল মানে এক অনন্য বিকাল, যা অন্য সময়ের থেকে আলাদা। এ সময়ের বিকালে গ্রামের ছেলেরা খেলাধুলায় মেতে থাকে। আমরা এদের থেকে তো আর আলাদা নই, তাই আমরাও আয়োজন করি বালিশ খেলা, কায়িকশ্রম দিয়ে বেলুন ফাটানো ও হাঁড়ি ভাঙার। খেলায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারীর জন্য ছিলো ভিন্ন ধাঁচে নতুন পুরস্কার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ছেড়ে আসতে মন চেয়েছিলা না, তবুও মাগরিবের নামাজ শেষে ইলেক্ট্রনিক ভ্যান যোগে গন্তব্যে চলে আসি। ক্যাম্পাসে সান্ধ্য চায়ের আড্ডা শেষে আমরা আমাদের নীড়ে চলে যাই। পুরোটা সময়জুড়ে আমাদের সঙ্গে থেকে আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ইবি ক্যারিয়ার ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আশিকুর রহমান ভাই।

ভ্রমণানন্দ শেষ হয়েও হইলো না শেষ, সে যেন শেষ হবার নয়। ভ্রমণ নতুন চিন্তা ও আবিষ্কারের পথ উন্মোচিত করে। যেমনটি মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন বলেছেন, ‘আজ থেকে ২০ বছর পর আপনি এ ভেবে হতাশ হবেন, আপনার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল তা করতে পারেননি। তাই নিরাপদ আবাস ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ুন। আবিষ্কারের

জন্য যাত্রা করুন, স্বপ্ন দেখুন আর শেষমেশ আবিষ্কার করুন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close