মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
শরৎ উৎসবে মেতেছে জবি ক্যাম্পাস
ঋতুচক্রের বর্ষ পরিক্রমায় শরতের আগমন ঘটে বর্ষার পরেই। বর্ষার বিষণœতা পরিহার করে শরৎ আসে। প্রকৃতি এ সময় নববধূর সাজে সজ্জিত হয়ে উঠে। শরতের মেঘহীন নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা কেড়ে নেয় প্রকৃতি প্রেমিকদের মন। শ্রাবণ শেষে মুষলধারায় বৃষ্টির সমাপ্তি ঘটলে বাংলার নিসর্গ নতুনভাবে সজ্জিত হয়। নভো-এর বুকে উড়ে বেড়ায় শুভ্রমেঘ, মেঘ-রোদের লুকোচুরি খেলায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে ঝলমলে, বাতাস হয়ে ওঠে অমলিন।
আকাশ ওই সময়ে গাঢ় নীল রঙের হয়ে থাকে। আকাশের ওই ঝলমলে নীল রঙের আভার কিনারা ছুঁয়ে ফুলের মালার মতো দলবেঁধে উড়ে যায় নানা জাতের পাখি। নিসর্গের বুকে শরৎ নিয়ে আসে এক অন্য রকম শোভা। এসময় বিভাবসুর কিরণে হরিৎ বর্ণের ধানক্ষেত হয়ে ওঠে চিরসুখময় স্থান। মৃত্তিকা ও সবুজ ধানগাছের ডগায় রৌদ্র-ছায়ার সৌন্দর্যবিষয়ক খেলা আমাদের মনকে মোহিত করে। বিলে শাপলা, গাছে গাছে শিউলির মন মাতানো সুবাস অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। শরতের রূপ যেন শান্ত-স্নিগ্ধ- কোমল। যেখানে মলিনতা নেই, আছে নির্মল আনন্দ আর অনাবিল উচ্ছ্বাস। কবি জীবনানন্দের ভাষায়, ‘যৌবন বিকশিত হয় শরতের আকাশে’।
শরৎ যেন অনেকটা শুভ্রতারই উৎসব। আর এ উৎসবের অন্যতম প্রতীক হিসেবে কাশফুলের বন বা কাশবন অতি পরিচিত দৃশ্য। এটা শরতের ফুল। নদীর তীরে কিংবা খালবিলের পাড়ে কাশফুলের দোল খেলা যেন শরতের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। যে ঋতুর অনিন্দ্য রূপ মানুষ-জাতিকে সবসময় মুগ্ধ করেছে। এসময়ে গাছগাছড়া হয়ে ওঠে প্রাণপূর্ণ ও মনোহরা।? চারপাশের পরিবেশ হয়ে ওঠে হরিৎ বর্ণের, ধানক্ষেত হয়ে ওঠে সবুজ প্রান্তর। নদীর ধারে, বিলের কিংবা খালের পাড়ে শরতের মৃদু বাতাসে দুলতে থাকে সাদা সাদা কাশফুল। শরতে শেফালি, মালতী, কামিনী, জুঁই, টগর আর সাদা সাদা কাশফুল মাথা উঁচিয়ে জানান দেয় সৌন্দর্য। মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। গ্রামীণ প্রকৃতিতে শরৎ আসে সাড়ম্বরে। যদিও ইট-কাঠের নগরীতে শরৎ থেকে যায় অনেকটা অন্তরালে।
নাগরিক জীবনে সাদা মেঘ আর কাশফুলের কথা মনে করিয়ে দিতে পঞ্জিকার পাতায় শরৎ এসেছে বেশ কিছু দিন আগে। ইট-কাঠের রাজধানী শহরে নেই শুভ্র কাশবন। দরদালানে আকাশ ঢাকা। তাই নীল আকাশজুড়ে তুলার মতো পেঁজা মেঘের ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য চোখে পড়ে না সহজে; কিন্তু কোথাও-না-কোথাও আছে ওসব। শরতের শুভ্রতা নিয়ে ফুটছে শিশিরভেজা শিউলি। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল স্নিগ্ধ সকালে দেখা মিলল শরতের দৃশ্যকল্প। তেমনি শরৎ এসেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও।
‘শুভ্র-নীল শাড়ি পরে, মেঘের ভেলায় ভেসে, শরৎ এলো শিমুল তুলোয়, কাশফুলের দোলায় নেচে’ প্রতিপাদ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎ উৎসব ১৪২৯ উদযাপন করা হয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর রবিবার ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় অডিটরিয়ামে এ অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক বলেন, এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের সাংস্কৃতিক যে ঐতিহ্য সেগুলো আমরা সমুন্নত রাখতে চাই। এদেশকে এগিয়ে নিতে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামেও অংশগ্রহণ করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ বলেন, শরৎ উৎসব অনুষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। এসব আয়োজনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে বিস্তৃত করা হয়। আমরা আশা করি এমন আয়োজনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।
এদিকে ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শরৎ উৎসব উদযাপন করা হয়েছে। বিভাগের শ্রেণি কক্ষে এ আয়োজন করা হয়। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা নেচে গেয়ে এ উৎসব উদযাপন করেছে। এ সময় বিভাগের চেয়ারম্যান, সিনিয়র অধ্যাপক, শিক্ষকমণ্ডলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ সব বর্ষের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগেও শরৎ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।
এছাড়াও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রীহল ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’ এ প্রথমবারের মতো শরৎ উৎসব ১৪২৯ উদযাপিত হয়েছে। শরতের স্নিগ্ধতার পরশ পেতেই এই আয়োজন। ১৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ছাত্রীহলের ১৪তলায় এ আয়োজনটি করে হলের ছাত্রীরা। এতে ছাত্রীহলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামীমা বেগম, হাউজ টিউটর প্রতিভা রানী কর্মকার সহ অন্যান্য সহকারী হাউজ টিউটর উপস্থিত ছিলেন। এসময় আবাসিক হলের ছাত্রীরাও হালকা নীল রঙের শাড়ি পড়ে শরৎ উৎসব উদযাপন করে। প্রথমবারের মতো আয়োজিত এ উৎসবে হলের ছাত্রীরা নেচে গেয়ে উদযাপন করেন। ছিল ছবি তুলার হিরিকও। এসময় বিভিন্ন ধরনের ফল ও মিষ্টির ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও ছাত্রী হলে বিভিন্ন ফ্লোরে আলাদা করে শরৎ উৎসবের আয়োজন করা হয়। হলের আবাসিক ছাত্রী সুমাইয়া শিমু বলেন, প্রথমবারের মতো শরৎ উৎসব আমাদের জন্য স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমরা এমন আয়োজনের বার বার করতে চাই। আশা করছি এমন আয়োজনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মেহরাব হোসেন অপি বলেন, নাগরিক কোলাহলের ভিড়ে আবহমান বাংলায় এমন উৎসব আয়োজন প্রশংসার দাবি রাখে। এসব অনুষ্ঠান সব সময় আমাদেরকে একটি বার্তা দেয়। আমরা উৎসব পালন করব বটে, তবে এ পালনের মধ্য দিয়ে একটি বড় বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যা আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে এসব অনুষ্ঠান বাংলার প্রকৃতি, পরিবেশ সবকিছুর সঞ্চার করে জনমনে। আমাদের সবার উচিত পরিবেশ-প্রকৃতি সংরক্ষণে নিজে সচেতন হওয়া ও অন্যকে সচেতন করা।
মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আফজাল হোসেন বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে যারা আঘাত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে দেশের তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ আজ এ শরৎ উৎসবের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন একাডেমিক দিনপঞ্জি রয়েছে, তেমনি এমন একদিনের প্রত্যাশা রাখি যেদিন একাডেমিক দিনপঞ্জির মতো একটি সাংস্কৃতিক দিনপঞ্জিও থাকবে। সেটিও একাডেমিক দিনপঞ্জির মতো গুরুত্ব পাবে।
নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী বিথী রানী মন্ডল বলেন, সংস্কৃতিও ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে। ছয়টি ঋতুকে ঘিরে বাংলা যেমন বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয় তেমনি সংস্কৃতির সঙ্গেও ঋতুর একটি যোগসূত্র সংস্কৃতির মাঝে দেখা যায়। নগর জীবনে বাংলাকে ঘিরে এমন আয়োজন যেন গ্রামীণ আবহে নিয়ে যায়। প্রকৃতির রূপ-রস ধরে রাখার জন্য প্রতিবছর শরৎ উৎসবের আয়োজন করা উচিৎ।
আকাশে ভেসে বেড়ানো শুভ্রমেঘ, নদীতীরে কিংবা খালপাড়ে মৃদুমন্দ বাতাসে দোলে ওঠা শুভ্র কাশফুল, ভোরে হেসে ওঠা শিশিরভেজা শিউলি-বকুল আর দেবী দুর্গার উপস্থিতি সব মিলিয়ে শরৎ যেন শুদ্ধতার ঋতু। শরতের রাতে মেঘহীন আকাশে জোছনার সৌন্দর্য খুব মনোহর। শরতের উপস্থিতিতে বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল, চড়ুই ও ময়নার মধুর গুঞ্জনধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। এক কথায় প্রকৃতি সাজে অপূর্ব সাজে। শরতের ভেতর আনন্দময় একটা ঘ্রাণ আছে যা অন্য কোনো ঋতুতে দেখা যায় না।
"