মো. আশিকুর রহমান সৈকত

  ১৫ মে, ২০২২

বিশ্ব বই দিবস ও কিছু কথা

মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন বইবন্ধু শেখ মুহাম্মদ আতিফ আসাদ। নিজ এলাকা জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের হাসড়া মাজালিয়ায় গড়ে তুলেছেন ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’। আতিফ অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০১৯-২০ সেশনে জামালপুর সরকারি কলেজে পড়েছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানে। বাবার পক্ষে তার পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব হতো না। এজন্য তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রী, খাট বার্নিশ ও ধান কাটার কাজ করেন। আতিফরা সাত ভাইবোন। অর্থের অভাবে কিনতে পারতেন না বই, পাননি প্রাইভেট পড়া এবং নিয়মিত স্কুল যাওয়ার সুযোগ। বইয়ের প্রতি প্রবল ভালোবাসা থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন গ্রামে একটি পাঠাগার করবেন। ছিল শুধু ইচ্ছাটাই- ছিল না আর্থিক সক্ষমতা, এমনকি পাঠাগার করার পর্যাপ্ত স্থান। বাধ্য হয়ে আতিফ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ঘরের বারান্দায় একটি পাঠাগার নির্মাণ করেন। তিনি মনে করেন, অ্যাকাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অসচ্ছল। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে গিয়ে বাবা-মাকে হিমশিম খেতে হয়। তাদের পক্ষে অন্যান্য বই কিনে জ্ঞান অর্জন করা অসম্ভব। এজন্য আতিফ বিনামূল্যে বই পাঠদানের জন্য শুরুতে তার ভাইয়ের সঙ্গে পাঠাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু জমি সংক্রান্ত বিবাদের জেরে ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তার ভাইকে হত্যা করা হয়। এই ভাই তাকে সব সময় পাঠাগার নির্মাণের জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তাই তিনি ভাইয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে তার নামেই পাঠাগারের নামকরণ করেন ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’। তার ঘরের বারান্দায় পাটকাঠি দিয়ে একটি ঘর বানান। সেখানে মাত্র ২০টি বই নিয়ে পাঠাগার নির্মাণ করেন। তার বিশ্বাস ছিল, যেহেতু এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো কাজ, তিনি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা পাবেন। ঘটেছেও তাই। বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুদান পেয়েছেন। বইও এসেছে অনেক। এভাবেই পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি জানান, পরিবার তাকে এ ব্যাপারে অনেক সাহস দিয়েছে। তার এ উদ্যোগে তার বাবা-মা ভীষণ খুশি। আজ পাঠাগারে প্রায় ২০০০ বই আছে। সপ্তাহে দুই-তিন দিন আতিফ আসাদ লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দেন। এ ছাড়াও যদি কেউ ১৫ কিলোমিটার দূর থেকেও ফোন করেন সাইকেল চালিয়ে গিয়ে বই দিয়ে আসেন তিনি। আসাদের মিলন স্মৃতি লাইব্রেরিতে প্রায় ১০০ পাঠক আছে। সময় ভেদে কমবেশিও হয়। অন্যদিকে লোকমুখে চলত কী শুরু করেছে ছেলেটা! এখন কী আর এই বইগুলো পড়ে কেউ! লেখাপড়া না করে মানুষের সেবা করবে! অনেকে সামনে না বললেও পিছে পিছে পাগল বলত তাকে। এভাবেই অনেকের উপহাসের শিকার হতে হতো আতিফ আসাদের। তাতে তার কষ্ট লাগত কিন্তু তিনি দমে যাননি। গ্রামে গ্রামে পাঠাগার করে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন পাঁচটি পাঠাগার। আতিফ আসাদের ইচ্ছা মৃত্যুর আগে উপজেলার প্রত্যেকটি গ্রামে একটি পাঠাগার নির্মাণ করার। এদিকে তার মাথায় আসে রেলওয়ে স্টেশনের কথা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত। এই প্ল্যাটফর্মকে ঘিরে সাংস্কৃতিক ও বই পড়া আন্দোলনের জাগরণ ঘটাতেই তার মাথায় আসে স্টেশন পাঠাগারের। স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা যাতে অবসর সময়ে বই পড়ে জ্ঞান লাভ করতে পারে। অপেক্ষমাণ বিরক্তিকর সময়ের ক্লান্তি যেন এই বই পড়ার মাধ্যমে কেটে যায় এবং জ্ঞান অর্জন করতে পারে। গ্রামে গ্রামে পাঠাগার করার পাশাপাশি ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশে প্রথম রেলওয়ে স্টেশন ভিত্তিক বই পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে ‘ইস্টিশন পাঠাগার’ এর যাত্রা শুরু। আরেকজন আবৃত্তিশিল্পী আসাদুজ্জামান রুবেলের সঙ্গে বিষয়টা আলোচনা করলে তিনি এই পাঠাগারটির নাম দেন ‘ইস্টিশন পাঠাগার’। মিলন স্মৃতি পাঠাগার ও রেডিও-১৯-এর যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তিনটি রেলওয়ে ‘ইস্টিশন পাঠাগার’। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মধ্য ময়মনসিংহ, জামালপুর, জয়দেবপুর, ভৈরব, লালমনিরহাট, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধায় ‘ইস্টিশন পাঠাগার’ উদ্বোধন করা হবে। তাদের স্বপ্ন সারা বাংলাদেশে ১০০টি রেলওয়ে স্টেশনে পাঠাগার স্থাপন করা।

বিশ্ব বই দিবসে প্রকাশনা সংস্থা নৃ-কথার পক্ষ থেকে আমাদের দ্বিতীয় প্রকাশনা ‘সুবর্ণ কথা’-এর ১০ কপি উপহার দেওয়া হয় মিলন স্মৃতি পাঠাগার ও ইস্টিশন পাঠাগারের পাঠকদের জন্য। আতিফ আসাদের মতো স্বপ্নবাজ বইবন্ধুদের স্বপ্ন পূর্ণতা পাক। ৫৬ হাজার বর্গমাইল বইয়ের হোক। বই দিবস সফল হোক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close