করোনাকালীন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষকদের ভাবনা
মহামারি করোনার প্রাণঘাতী প্রকোপের ফলে দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পাশাপাশি কার্যকর করা হয় কঠোর লকডাউন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এখন প্রায় ১৭ মাস চলছে। এরমধ্য দিয়ে চলমান আছে অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ও পরীক্ষাসমূহ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ কয়েকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার গুঞ্জন শোনা গেলেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি এখন পর্যন্ত। শিক্ষামন্ত্রী বেশ কয়েকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে পুনরায় পিছিয়েছেন। করোনাকালীন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কী ভাবছেন আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় শিক্ষকরা? তাদের মতামত তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মিজানুর রহমান
যথাযথ মূল্যায়নে দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে বন্ধ আছে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নীতিগত সিদ্ধান্তে অনলাইন ক্লাসসমূহ আমাদের সীমিত সক্ষমতার মধ্যে দিয়ে চালু রয়েছে এখন পর্যন্ত। দেশের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারের আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে থেকে গেছে পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা, ডিভাইস সহজলভ্যতার মতো নানাবিধ সীমাবদ্ধতা। যেমনটা পরিলক্ষিত হচ্ছে বর্তমান অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে। এ সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে অনলাইন ক্লাস চালুর ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই সংশ্লিষ্টদের আরেকটু কৌশলগত সীদ্ধান্ত যেমন অনলাইন ক্লাসগুলো কীভাবে সংগঠিত হবে, ক্লাসের মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, পরীক্ষা পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করার প্রয়োজন ছিল। কেননা অনলাইন ক্লাসের যথাযথ মূল্যায়নটুকু নিশ্চিত করতে না পারলে এর ইফেকটিভনেস বা কার্যকারিতাটুকু পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে অনলাইনে আলাদা আলাদা ইভেন্ট পরিচালনা করা যেতে পারে। প্রতিটি ইভেন্টে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট একটি নম্বর পাবে। ক্লাসে উপস্থিতির ওপর নম্বর থাকবে, অ্যাসাইনমেন্ট, গ্রুপ প্রেজেনটেশন, কুইজ টেস্ট, মৌখিক পরীক্ষা এবং সর্বশেষে কিছু নম্বরের
লিখিত পরীক্ষা বা ক্রিয়েটিভ অ্যাসাইনমেন্টের
ওপর নম্বর রাখা যেতে পারে। এভাবে মূল্যায়নগুলো করতে পারলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিতের পাশাপাশি অ্যাকাডেমিক পড়াশোনায় বেশ এগিয়ে যাবে।
শামীম নূর
সহকারী অধ্যাপক
লোকপ্রশাসন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা দুটোই নেওয়া সম্ভব
করোনার কারণে ২০২০-এর মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধ নয় ঠিক, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। দেশের মানুষ যদিও মনে করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধই আছে। আমাদের দেশের মানুষ ক্লাস মানে বুঝেন সরাসরি শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি। বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। তবে অনলাইন ক্লাসের কার্যকারিতা ও সমান সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে। বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু আমাদের সামনে এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প উপায় নেই। অনেক দিন ধরে ক্লাস হচ্ছে, কিন্তু পরীক্ষা কবে হবে? পরীক্ষা নিয়ে আছে নানামত। অনেকে অনলাইনে পরীক্ষা নিতে নারাজ। অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক আপত্তি আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি পরীক্ষা শুরুও করেছে। কিন্তু ডেল্টা ধরন সব ভেস্তে দিল। আমি মনে করি, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার আয়োজন করা উচিত। যাদের ল্যাবের ব্যবহার নেই, তারা অনায়াসে অনলাইনে পরীক্ষা নিতে পারে এবং নেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা অনলাইনে নিলে অনেক সময় বিদ্যমান প্রশ্নমালায় সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে ভিন্নভাবে পরীক্ষা নেওয়া যায়। যেমন গুগল ফর্ম ব্যবহার করে এক বাক্যের প্রশ্নমালা তৈরি করা যায়। টিউটোরিয়াল, অ্যাসাইনমেন্ট, ভাইভা, ওপেনবুক পরীক্ষাসহ অসংখ্য পদ্ধতি অবলম্বন করে পরীক্ষা নেওয়া যায়। আমি শুধু বলি, আমাদের পরীক্ষা নিয়ে নেওয়া উচিত। এ পরিস্থিতিতে সব দেশ অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে। আমাদের নিতে সমস্যা কোথায়?
মুহাম্মদ মহিউদ্দীন
ডক্টরাল গবেষক, ফেরারা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি; সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মফস্বলের শিক্ষার্থীদের কথা ভাবতে হবে
মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতী প্রকোপের কারণে বছর দেড়েক ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব পর্যায়ের বিদ্যাপীঠ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুদীর্ঘ এ বন্ধে আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জগৎ থেকেও বেশ পিছিয়ে পড়েছে। দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই মফস্বলের প্রত্যন্ত গ্রাম, দ্বীপ, হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চলের শিক্ষার্থী। সে কারণে শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত স্মার্ট ডিভাইস ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় সেসব শিক্ষার্থীকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। যারা শহরে বসবাস করে তাদের জন্য ইন্টারনেট সেবা খুব সহজতর। কেননা শহরের শিক্ষার্থীরা চাইলেই সবকিছু হাতের নাগালে পাচ্ছে। কিন্তু মফস্বলের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। মফস্বলের বেশির ভাগের মধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা ততটা নাও থাকতে পারে। আর থাকলেও মফস্বলে খরচ একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমি মনে করি, অন্তত ফেসবুকে প্রতিটি ক্লাসের পেজ থাকা দরকার। সেখানে প্রতিটি ক্লাসের ভিডিও আপলোড করা হবে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা যারা নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে লাইভে ক্লাস করতে পারবে না তারা ভিডিও ডাউনলোড করে পরবর্তীতে ক্লাসটি দেখতে পারবে। এ ছাড়াও আমাদের শিক্ষকদের উচিত মাঝেমধ্যে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নেওয়া। এরই মধ্যে দু-একটা প্রশ্ন করা। শিক্ষার্থীরা করোনা প্যান্ডেমিকে কী শিখল, তা যাচাই করে দেখা। আমরা যখন একজন শিক্ষার্থীকে ফোন করব, তখন সে শিক্ষার্থী অবশ্যই উৎফুল্ল হবে, মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং কিছু করার প্রেরণা পাবে।
সেগুপ্তা ইসলাম
প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান
ইংরেজি বিভাগ, আইডিয়াল কলেজ, ধানমন্ডি।
অনেক শিক্ষার্থী গুগল ক্লাসরুমে ঢুকতে জানে না
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খুব সীমিতসংখ্যক শিক্ষক অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। তাহলে বাকি শিক্ষকরা কী করছেন? বাকি শিক্ষকদের অধিকাংশের অবস্থা এমন বিদ্যুৎ চলে গেলে ওয়াইফাই চলে যায়। শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করেন কখন শিক্ষক আসবেন। কারণ শিক্ষক জানেনই না ওয়াইফাই ডিভাইসের সঙ্গে ব্যাকআপ ব্যাটারি সংযুক্ত করা যায়, আবার জানলেও ডিভাইসটি কিনেননি। অনেকে আবার অর্থ ব্যয় করে মোবাইল ডেটা ব্যবহার করেন না। প্রযুক্তির সব সুবিধা নিয়ে কোর্স সম্পন্ন করেছেন অনেক আগেই, কিন্তু পরীক্ষা নিতে পারছেন না, পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষমতা যেন উনাদের হাতে নেই!
শিক্ষার্থীদের কথা বলতে গেলে হাজার হাজার সমস্যা তাদের। কারো নেটওয়ার্ক থাকে না, কারো মোবাইলের ডেটা থাকে না, কারো কারো আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ পড়াশোনার কথা ভাবতেও পারছে না। করোনার পর অনেক দিন হয়ে গেল, তবু অনেক শিক্ষার্থী গুগল ক্লাসরুমে ঢুকতে জানে না। গুগল ক্লাসরুমে পরীক্ষা দিতে জানে না, নিজের লেখনীকে পিডিএফ ফাইলে রূপান্তর করতে জানে না। অথচ এসব সমস্যার সমাধান ইউটিউবে দুই মিনিটের ভিডিও ক্লিপস দেখলেই পাওয়া যায়। তবে কিছু কিছু ব্যতিক্রম শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা প্রচুর পরিশ্রম করছে। নিজের বাসা হতে বের হয়ে অদূরে কাঁঠালবাগানে, লেবু বাগানে, ছাদের ওপর বসে ক্লাস করছে, পরীক্ষা দিচ্ছে। তাই আমি মনে করি, চলমান অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষাকে আরো অধিকতর ফলপ্রসূ করে তুলতে দ্রুততার সঙ্গে এসব ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমস্যার সমাধান করার বিকল্প নেই।
ড. তানভীর ম হ আরিফ
অধ্যাপক, ফিন্যান্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
"