বিশ্বজিৎ ঘোষ

  ১৫ আগস্ট, ২০২২

বঙ্গবন্ধুর ভাষা ও সাহিত্যচিন্তা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বব্যাপী একজন মুক্তিসংগ্রামী এবং মহান রাজনীতিবিদ হিসেবে সমধিক পরিচিত। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি রাজনীতির মানুষ- রাজনীতি তার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। তিনিই বাঙালির শ্রেষ্ঠতম জাতীয়তাবাদী নেতা। বাঙালির সম্মিলিত চেতনায় জাতীয়তাবোধ সঞ্চারে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। গণতান্ত্রিক মূল্যচেতনা এবং অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা- এই দ্বৈত বৈশিষ্ট্যই বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূলকথা। শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি। এই আকাঙ্ক্ষাকে তিনি সঞ্চারিত করে দিয়েছেন বাঙালির সামূহিক চেতনায়।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, প্রকৃত অর্থে, অভিন্ন ও একাত্ম। বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে অনিবার্যভাবে এসে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। জনগণের স্বার্থ ও দেশের স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে তিনি একাত্ম করতে পেরেছেন। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, দেশের স্বার্থের কাছে, জনগণের স্বার্থের কাছে তিনি জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন নিজের স্বার্থ। বিশ্ব-ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয়তাবাদী নেতার দৃষ্টান্ত বিরল। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি জাতীয় পুঁজির আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষা ও বাঙালির সম্মিলিত মুক্তির বাসনাকে এক বিন্দুতে মেলাতে পেরেছেন। বিশ্ব-ইতিহাসে কোনো জাতীয়তাবাদী নেতার কর্মসাধনায় আমরা এই যুগলস্রোতের মিলন লক্ষ করি না।

শোষক ও শোষিতের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শোষিত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে তিনি কখনো দূরে সরে যাননি। ভীতি ও অত্যাচারের মুখেও সর্বদা তিনি সত্যের কথা বলেছেন, শোষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। শোষিত মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই অবস্থানের কারণে তিনি শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বিশ্বমানুষেরই অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন- এসব সংস্থায় শোষিত মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।

২.

সূচনা-সূত্রেই ব্যক্ত হয়েছে যে, রাজনৈতিক সত্তাই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় পরিচয়। তবে শুধু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তিই নয়, বাংলাদেশের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মুক্তিসংগ্রামেও অন্যতম নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বস্তুত, তার সাধনার মধ্য দিয়েই ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি রচিত হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ভাষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।

রাজনীতির মানুষ হয়েও রাজনীতির বাইরেও নানা বিষয় নিয়ে ভেবেছেন বঙ্গবন্ধু- খেলাধুলা, চলচ্চিত্র, ভাষা, সাহিত্য, সংগীত কিছুই তার চিন্তার বাইরে ছিল না। অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২) কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) এবং আমার দেখা নয়াচীন (২০২০) প্রকাশের পর তাকে একজন লেখক হিসেবে চিনে নেওয়ারও ঐতিহাসিক সুযোগ ঘটেছে বিশ্ববাসীর। তবে এতসব বিষয় নয়, আজকের এ লেখায় বঙ্গবন্ধুর ভাষা ও সাহিত্যচিন্তা সম্পর্কেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা এবং বাংলা সাহিত্য- সবকিছুর প্রতিই ছিল বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসা। বাংলার ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনার একটা নির্যাস পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক অধিবেশনে দেওয়া তার ভাষণ থেকে। ওই ভাষণে নিম্নোক্ত অংশ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ধারণার একটা সুস্পষ্ট রূপ প্রকাশিত হয়েছে :

‘আমরা বাঙালি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমি যদি ভুলে যাই আমি বাঙালি, সেদিন আমি শেষ হয়ে যাব। আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি, আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরব, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা আমার কৃষ্টি ও সভ্যতা।’

বাংলা ভাষার উন্নতি ও বিকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও চিন্তা বিভিন্ন ভাষণ থেকে আমরা জানতে পারি। বাংলা ভাষার উন্নতি ও বিকাশের জন্য বঙ্গবন্ধু সব সময় সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রেরণা দিয়েছেন- তাদের নির্ভয়ে কাজ করার সাহস জুগিয়েছেন। ভাষা যে নদীস্রোতের মতো প্রবহমান, বঙ্গবন্ধু তা যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছেন। কখনো কখনো এসব প্রসঙ্গে একজন ভাষাতাত্ত্বিকের মতোই বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছেন তার ভাবনা। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত ভাষা-আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন : ‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভেতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। এই মুক্ত পরিবেশে বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের অতীত ভূমিকা ভুলে স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলুন। জনগণের জন্যই সাহিত্য। এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনীর মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কেউ আপনাদের বাধা দিতে সাহস করবে না।’ উদ্ধৃত অংশ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্যন্তিক আকাঙ্ক্ষার কথা সম্যক উপলব্ধি করা যায়।

বাঙালির অংহকার আর গৌরবের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও চিন্তক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম দিন থেকেই রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ছিলেন গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে তার এই সম্পৃক্তি বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার প্রত্যক্ষ প্রকাশ। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মন্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলেন, ‘উর্দুই হবে পকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। নাজিমুদ্দিনের ঘোষণায় ভাষা-আন্দোলন নতুন করে চাঙা হয়ে ওঠে। জেলে থেকেই গোপনে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিতে থাকেন, যোগাযোগ গড়ে তোলেন আন্দোলনের সংগঠকদের সঙ্গে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের উদ্দেশ্যে অসুস্থতার কথা বলে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্য থেকেই নেওয়া যাক ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্তির কথা :

‘আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দি অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে, রাষ্ট্রভাষার ওপর ও আমার দেশের ওপর যে আঘাত হয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তার মোকাবিলা করতে হবে। সেখানেই গোপন বৈঠকে সব স্থির হয়।... কথা হয়, ১৬ ফেব্রুয়ারি আমি জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট করব, আর ২১ তারিখে আন্দোলন শুরু হবে। জেলে দেখা হয় বরিশালের মহিউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে। তাকে বললাম, আমরা এই প্রোগ্রাম নিয়েছি। তিনি বললেন, আমিও অনশন ধর্মঘট করব। ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে আমরা অনশন ধর্মঘট করলাম। এর দরুন আমাদের ট্রান্সফার করা হলো ফরিদপুর জেলে। সূচনা হয় ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের।’

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্তির কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। ভাষার প্রতি ভালোবাসা ছিল বলেই বন্দিজীবনেও তিনি পালন করেছেন দুঃসাহসিক ভূমিকা। হাসপাতালে বসেই তিনি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, দিয়েছেন প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। ...আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরো বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরো কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে।... আরো দু-একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই এলো। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি আরো বললাম, আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব।’

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং বাংলা ভাষা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর প্রাতিস্বিক ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। সব মানুষই মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। প্রসঙ্গত, এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- যেকোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনোকালে সহ্য করে নাই। এখানে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা তার মধ্যে কোনো সংকীর্ণ ভাষা-চিন্তার জন্ম দিতে পারেনি। উদার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তিনি সব ভাষার প্রতিই তার সমান ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেছেন। পাকিস্তানের বৃহত্তর বাস্তবতায় বাংলার পাশাপাশি উর্দুসহ অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষাকে স্বীকৃতির পক্ষে তিনি সুস্পষ্ট মত দিয়েছেন। অথচ বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধ আচরণের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচলিত ভাষায় তিনি বিরুদ্ধাচরণ করতে পারতেন। এ বিষয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি ব্যক্ত করেছেন এই সুস্পষ্ট অভিমত :

বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবু আমরা বাংলা ও উর্দু দুটি রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবু যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন?

বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করতে ভালোবাসতেন- বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা থেকেই তিনি বাংলায় বক্তৃতা করতেন। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে বেইজিংয়ে আয়োজিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিদের শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করেন। আমাদের অনেকেরই জানা যে, শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন, যা ইংরেজি, চীনা, রুশ ও স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করে উপস্থিত প্রতিনিধিদের শোনানো হয়। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ...কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’ উত্তরকালে, ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছেন।

শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি-ভাষণেই নয়, আইন সভাতেও বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার পক্ষে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন সাহসী ভূমিকা। ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো ছাড়াও তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ চান। স্পিকার ওহাব খান পশতু ভাষা না-জানা সত্ত্বেও একজন সদস্যকে ওই ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করার সুযোগ চান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ না-দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ জানান, অন্যান্য সদস্য নিয়ে ওয়াক আউটের হুমকি দেন। স্পিকারের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন :

...I would request you to revise your ruling and allwo Honorable Members to speak in Bengali which is going to be one of the state language of Pakistan. It is a very serious matter for us

and here nobody can force us not to speak in our own mother-tongue. I will here and nwo speak

in Bengali and nobody can prevent me from doing that. If you are not going to allwo me to

speak in Bengali, then all the Awami League members will have no alternative but to walk out

of the House, as a protest. অভিন্ন দিনে গণপরিষদে তিনি বলেন, ‘আমরা ইংরেজি বলতে পারব, তবে বাংলাতেই আমরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যদি পরিষদে আমাদের বাংলায় বক্তৃতার সুযোগ না দেওয়া হয় তবে আমরা পরিষদ বয়কট করব।... বাংলাকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করব।’

পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তি বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাংলার পরিবর্তে রোমান বা উর্দু হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এক রাষ্ট্র এক ভাষা স্লোগান উত্থাপন করে বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের পাঁয়তারা করতে থাকে পাকিস্তানি শাসকরা। বর্ণমালা পরিবর্তনের সরকারি এই প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রকে বিরোধিতা করে বঙ্গবন্ধু যৌক্তিকভাবে বলেন এ কথা : ‘কে না জানে যে, সমগ্র ইউরোপই রোমান হরফ ব্যবহার করিয়া থাকে। কিন্তু একই হরফের ব্যবহার ইউরোপীয় সংহতির জন্য সহায়ক হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে ১১টি দেশে আরবি হরফ প্রচলিত রহিয়াছে। কিন্তু একই হরফ থাকা সত্ত্বেও আরব বিশ্বে কোনো একতা নেই।’

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের প্রাক্কালে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার ওপর বঙ্গবন্ধু বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য, ১৯৫২ সালের মতো, যেকোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকারের জন্য তিনি বাঙালিকে আহ্বান জানান। ১৯৬৯ সালের ১ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রকাশ উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ভাষা-ভাবনার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে। সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন :

‘পাকিস্তানের সর্ব অঞ্চলে মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে যত শিগগিরই সম্ভব শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রচলন করিতে হইবে এবং পাকিস্তানের সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক জীবনে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রসারের চেষ্টা করিতে হইবে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার উন্নতি ও বিকাশের জন্য কার্যকর উৎসাহ প্রদান করিতে হইবে এবং সকল প্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।’

স্বাধীনতার পর অতি অল্প সময়ে বাংলা ভাষায় সংবিধান রচনা করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। আদালতের রায় বাংলা ভাষায় লেখার নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। যথাযথ পরিভাষা না থাকার কারণেই রাষ্ট্রের সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিতে পারে- এ কথা অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বঙ্গবন্ধু যে কত আন্তরিক ছিলেন, ওপরের ভাষ্য থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়।

শুধু মাতৃভাষা বাংলা নয়, বাংলা সাহিত্যের প্রতিও ছিল বঙ্গবন্ধুর গভীর অনুরাগ। বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কবিতা অবলীলায় উচ্চারণ করতেন। সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গণমানুষের উন্নতির কথা ভেবেছেন- সাহিত্যিককে সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু মনে করেন- জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিনই মহৎ সাহিত্য রচিত হতে পারে না। শুধু শহর নয়, গ্রামীণ জীবন ও জনপদকেও সাহিত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহিত্য প্রসঙ্গে যে কথা বলেছেন, তা তার প্রাতিস্বিক সাহিত্যভাবনারই শিল্পিত ভাষ্য।

৩.

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মর্মে মর্মে রাজনীতিবিদ হয়েও ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তা ভাবলে রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। তিনি ছিলেন রাজনীতির কবি- Poet of politics। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মধ্যবিত্তের শাহরিক ভাষার পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেছেন লোকভাষা। তার লেখা ও বক্তৃতায় লোকভাষা-আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের বিস্ময়কর সার্থকতা লক্ষ করা যায়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি। বঙ্গবন্ধু শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন- তার ভাষা ও সাহিত্যচিন্তা সে-স্বপ্নেরই সমার্থক এক অনুষঙ্গ।

লেখক : প্রাবন্ধিক-গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close