ইলিয়াস ফারুকী
একজন শৌখিন ও ভালোবাসাময় মানুষ
মানুষের নাম তার নিজের চেয়েও স্ফীত হয় তার কর্মে। পৃথিবীর সব কর্মদক্ষতা অভিজ্ঞতা মূল্যায়িত হয়ে মানুষটার ব্যক্তিত্বে। একজন মানুষ সমাজের যত বড় স্থান দখল করুক না কেন, যতই নামিদামি হোকনা কেন, তার নিজস্ব কিছু কর্মকাণ্ড, কিছু শখ থাকে, যা তার একান্তই নিজস্ব। নিজের আনন্দের জন্য, ভালোবাসার জন্য। এটা এতটাই একান্ত ব্যক্তিগত ভালোলাগা, যা ওই ব্যক্তিকে দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেয়। ভালোবাসাময় জীবনকে উপভোগ করায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এর থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন না।
শৈশবে তিনি ছিলেন দুরন্ত উচ্ছল ও চঞ্চল। নিজের দিনগুলোকে তিনি আনন্দঘন করে তুলতেন। বিমর্ষতা কী তা যেন তিনি জানতেনই না। গ্রামের মেঠোপথে ধুলো উড়িয়ে আনন্দে বর্ষায় বৃষ্টিতে গা ভেজাতেন। খুব ভোরে সবুজ ঘাসের পাতায় লেগে থাকা শিশিরের স্পর্শে নিজেকে সতেজ করে তুলতেন। বিষয়টি তাকে প্রচুর আনন্দ দিত। সময়-অসময় মনের আনন্দে তার গ্রাম্য নদী ‘বাইগার’-এ ঝাঁপিয়ে পড়তেন। নিজের ইচ্ছেমতো সাঁতার কাটা ছিল তার অন্য শখের মাঝে প্রধান একটা শখ। পশুপাখির প্রতিও ছিল তার প্রচুর টান। এক দিনের ঘটনা কোথাও থেকে যেন তিনি একটি শালিক পাখির ছানা কুড়িয়ে পেলেন। পাশাপাশি সময় পেয়ে গেলেন আরেকটি ময়না পাখির ছানা। পাখি দুটির যত্নে তিনি তার দিনমান এক করে ফেললেন। একই সঙ্গে পুষতে শুরু করলেন বানর ও কুকুর। যত্ন করে ধৈর্য সহকারে শালিক ও ময়না পাখির ছানাকে শিস দেওয়া শেখালেন। ময়নাকে কথা বলা শেখালেন। বিশেষ করে বানর ও কুকুর তার এতটাই ভক্ত ছিল যে, যতক্ষণ বাড়িতে থাকতেন ওদের সঙ্গে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতেন। এদের প্রতি কারো অবহেলা তিনি মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। তার খাদ্য তালিকায় মাছের ঝোল আর ভাতের পরেই প্রিয় খাবার ছিল দুধভাত কলা ও গুড়। খেলাধুলায়ও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। তিনি ভলিবল ও হকি খেলতেন। কিন্তু তার সবচেয়ে পছন্দের খেলা ছিল ফুটবল। তার বাবাও ছিলেন ফুটবলপ্রিয় মানুষ। বাবা এবং ছেলে দুজনেরই নিজস্ব ফুটবল টিম ছিল। ফুটবলের প্রতি তারা এতটাই অন্তপ্রাণ ছিলেন যে, বাবা-ছেলে নিজেদের দল নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। নদীতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে মাছ শিকার তার শখের অন্যতম একটি বিষয় ছিল। তার সব শখকে ছাপিয়ে যে শখ সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল, যা ছিল তার লেখালেখির শখ। সময় পেলেই তিনি লেখালেখি করতেন। বিশেষ করে তার জেলখানার বন্দিজীবনকে তিনি শুধু শুধু বৃথা যেতে দেননি। জেলখানায় বসে প্রচুর লেখালেখি করেছেন, যার ফলে আমরা পেয়েছি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়া চীনের’ মতো বই। তার এই লেখালেখির ব্যাপারে তাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেছিলেন তার জীবনসঙ্গী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার বন্দি অবস্থায় তিনি যখনই তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, সঙ্গে করে কাগজ-কলম অবশ্যই নিয়ে যেতেন। বন্দিজীবনের তার আরো একটি চমৎকার শখ গড়ে উঠেছিল। তিনি যে সেলে বন্দি থাকতেন তার আশপাশে তিনি ফুলের বাগান গড়ে তুলতেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ছিল তার প্রচুর ভালোবাসা। তার সর্বক্ষণের সঙ্গী একটি ব্যাগে সব সময় কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বই রাখতেন। কিংবদন্তি কবিদের অনেক কবিতাই তার মুখস্থ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা’ কবিতাটি তিনি প্রায়ই আবৃত্তি করতেন। জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারের রূপ’ এবং বন্ধু শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস ‘সংশপ্তক’ পাঠ করেন। প্রতিপক্ষকে তিনি নিয়ম মেনেই ঘায়েল করতে কসুর করতেন না। তাই তো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে করাচি ভ্রমণের সময় পাকিস্তানি আইনজীবীকে শুনিয়ে নজরুলের বেশ কটি কবিতা বাংলায় পাঠ করেন, যা পরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব ওদের ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনান। কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসা থেকেই তিনি দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিন্ন ভাষার সাহিত্যিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। এদের মধ্যে উর্দু ভাষার সাহিত্যিক ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এবং কবি নাজিম হিকমতের নাম উল্লেখযোগ্য। কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই তিনি তাকে বাংলাদেশ নিয়ে আসেন।
একটি স্যান্ডো গেঞ্জি এবং লুঙ্গি পরিহিত একজন মানুষ, মনের সুখে পাইপে হাত বসে আছেন, এমন একটি বিখ্যাত ছবি রয়েছে। সবাই জানেন তা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। পাইপ ছিল তার খুবই শখের। জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় নিজের জীবন আদর্শ গড়েছিলেন, যাতে ছিল আবেগ এবং ভালোবাসা। তার বাড়িতে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি যে আতিথেয়তা দেখাতেন, তা ছিল অতুলনীয়। এমনকি সব নিয়মণ্ডকানুনকে পাস কাটিয়ে নিজের বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডকেও পরম স্নেহে কাঁধে হাত রেখে খাবার নিমন্ত্রণ জানাতেন। তার পুরোটা জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার প্রধান শখ কিংবা অভ্যাস ছিল মানুষকে ভালোবাসা এবং বিশ্বাস করা। এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বিশ্বাসের কাছে তিনি তার জীবন সমর্পণ করে গেছেন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
"