সুবীর হোমরায়

  ১৫ আগস্ট, ২০২২

বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের স্বপ্নের নায়ক

সে দিনের কথা আজ খুব মনে পড়ে। ১৫ আগস্ট দিনটা এলে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসি ময়মনসিংহ থেকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ে আশ্রয় নিই পরিবারের সঙ্গে। যুদ্ধ শেষে ফের ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করি। থাকতাম জগন্নাথ হলে। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লাম। আমি তখন ভালো ক্রিকেট খেলতাম। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছেলেরা আমাদের হলের মাঠে ক্রিকেট খেলতে আসত। কারণ, ওদের মাঠ ছিল না। সলিমুল্লাহ হলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কামাল ভাই, মানে বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল। আমার থেকে এক বছরের বড় ছিলেন। উনি ম্যাট্রিক দেন ৬৭-তে। আমি পাস করি ৬৮-তে। একদিন খেলার মাঠেই কামাল ভাইয়ের বন্ধু মুনির ভাই আমায় তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করলেও অচিরেই আমি হয়ে উঠলাম কামাল ভাইয়ের আপনজন।

আমি গান-বাজনা আর ছবি আঁকতাম। আর কামাল ভাই নাটক খুব ভালোবাসতেন। ফলে বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হয়ে উঠল। টিএসসি চত্বরে আমাদের আড্ডা হতো প্রতিদিনই। এই আড্ডার মধ্যমণি কামাল ভাই। বঙ্গবন্ধুর ছেলে বলে তার মধ্যে কোনো দিনই কোনো অহংকার দেখিনি। সবাইকেই আদর করে তুই সম্বোধন করতেন। ৭৫ সালের ১৭ জুলাই বিয়ে করেছিলেন কামাল ভাই। আর সেই আনন্দে আমরা তাকে ধরে বসলাম খাওয়াতে হবে। ঢাকা স্টেডিয়ামের সামনে প্রভিন্সিয়াল বলে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখান থেকে বিরিয়ানি এনে আমাদের খাওয়ালেন।

আমি ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া আপার (মতিয়া চৌধুরী) গ্রুপ করতাম। ডাকসুতে তখন ছাত্র ইউনিয়নের রমরমা অবস্থা। ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সম্মেলন উপলক্ষে দেশজুড়ে পোস্টার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আমি প্রথম হয়েছিলাম। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ উদ্বোধনী সম্মেলন মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে সেদিন আমি মেডেল আর সার্টিফিকেট নিয়েছিলাম। এখনো আমার কাছে আছে সেগুলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু এ রকম হয়ে যাবে, তা ভাবতেও পারিনি। প্রকাশ্যে কোনো দিন আমি বঙ্গবন্ধুবিরোধী বক্তব্য বা তার সমালোচনা কোনো মানুষের কাছ থেকে সে সময় শুনিনি। তখন বুঝতে পারিনি, লুকিয়ে থাকা রাজাকার-আলবদররা চক্রান্ত চালাচ্ছে গোপনে। বঙ্গবন্ধু তখন শুধু আমার নয়, আমাদের সবার স্বপ্নের নায়ক; যিনি আমাদের একটা স্বাধীন মানচিত্র দিয়েছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। ১২-১৩ আগস্ট থেকে আমরা প্রথম দেখলাম, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচুর পোস্টার লাগানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। জাসদের একটা গ্রুপ এই পোস্টারিং করেছিল। বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে ১৪ তারিখ আমরা সারাদিন শাপলা চত্বর থেকে পুরো ক্যাম্পাস সাজাচ্ছিলাম। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছিলাম। রাত পৌনে ২টা নাগাদ কামাল ভাই ক্যাম্পাসে এলেন সব দেখতে। তিনি দুই আসনের একটা কচি কলাপাতা রঙের টয়োটা স্টারলেট গাড়ি চালাতেন। কিছুক্ষণ থাকার পর বললেন, ‘বাসায় যাই।’ আমি তাকে থাকতে অনুরোধ করলাম। কামাল ভাই বললেন, ‘নারে, আমার তো বাসায় যাইতে হবে। বিয়া কইরা ফাইসা গেছি।’

সকালে আসবেন বলে কামাল ভাই চলে গেলেন। সেটাই আমাদের শেষ দেখা। আজ ভাবি, তিনি যদি বিয়ে না করতেন, তাহলে হয়তো বাসায় সেদিন যেতে হতো না। আমাদের সঙ্গে থাকতেন। তাহলে তাকে এভাবে প্রাণ হারাতে হতো না।

১৫ তারিখ খুব ভোরে আমি আমার হলে চলে এলাম গোসল করার জন্য। ভোর ৫টা নাগাদ অনেক গুলির আওয়াজ শুরু হলো। হলের বাইরে বের হয়ে টিএসসির সামনে গিয়ে দেখলাম, রমনা থানার দিক থেকে গুলির আওয়াজ আসছে।

আমি, অজয় দাশগুপ্ত, মৃণাল সরকার আর কার্তিক চ্যাটার্জি ডাকসুর দিকে গেলাম। সেখানেও দেখলাম সব সুনসান। কেউ নেই। অজয়দা বললেন, চলো, মেডিকেলে যাই। মেডিকেলের ক্যান্টিনে গিয়ে হেলাল ভাইকে সব বললাম। আমরা নিচে নেমে এসে দেখলাম, করিডোরে আর্মি ভরে গেছে। সবাইকে মেডিকেল থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ওখান থেকে সরে গিয়ে আউটডোরের সামনে এলাম। আউটডোরের জানালা দিয়ে দেখলাম, চারটি লাশ স্ট্রেচারে শোয়ানো। কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল না বলে দেখতে পেলাম, আবদুর রব সেরনিয়াবাত আর শেখ ফজলুল হক মনির রক্তাক্ত লাশ। বাকি দুটি লাশ শিশুর। বুঝতে পারলাম, যা বলা হচ্ছে তা সত্যি : বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারকে খুন করেছে জল্লাদরা। আমার কামাল ভাইকেও তারা মেরে ফেলেছে। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

অজয়দা বলল, আর এখানে থাকা যাবে না। শেল্টারে চলে যেতে হবে। আবার দেশ ছাড়লাম। পালিয়ে চলে এলাম কলকাতায়। স্থায়ীভাবে আর ফেরা হয়নি আমার মাতৃভূমিতে। আজও ঢাকায় গেলে জগন্নাথ হলে, টিএসসিতে যাই। কামাল ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা-স্মৃতি বারবার ফিরে আসে।

লেখক : শহীদ শেখ কামালের বন্ধু

সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close