ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

  ১৫ আগস্ট, ২০২২

১৫ আগস্ট ১৯৭৫

ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যার অন্তরালে

২১ ডিসেম্বর ১৯৭৩, সাংবাদিক মাইকেল বার্নস New Statesman সাময়িকীতে বাংলাদেশের ওপর একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। প্রতিবেদনটি তার নিজস্ব ধারণামূলক ছিল না; প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু সরেজমিনে গিয়ে সংগৃহীত তথ্যভিত্তিক। কারণ তিনি বাংলাদেশে এসে সব দেখে-শুনে এবং জেনে-বুঝে সত্যভিত্তিক প্রতিবেদন রচনা করেছিলেন। আমি প্রতিবেদনটি পড়েছিলাম এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে (আমি তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)। প্রতিবেদনটির শেষ দিকে আমার চোখ আটকে গেল, যেখানে লেখা হয়েছিল, ‘আগামী বিপজ্জনক ও জটিল বছরগুলোতে অনেক দিন বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে মুজিব ধরনের নেতৃত্ব’। কিন্তু মাইকেল বার্নস এবং খুনিদের হিসাবে গরমিল ছিল; ১৯৭২ থেকে ষড়যন্ত্র শুরু করে তারা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সফল হয়েছিল, ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন বঙ্গবন্ধুসহ ১৭ জনের প্রাণ হরণ করা হয়েছিল।

১৬ আগস্ট, লন্ডন টাইম্সে সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল, ‘শেখ মুজিবকে যদি এমন হৃদয়বিদারকভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রয়োজন ছিল না’। রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যা নজিরবিহীন নয়; কিন্তু স্বজন-পরিজনসহ, এমনকি ১০ বছরের ছোট শিশু রাসেলকে হত্যা, দৃষ্টান্তরহিত। শুধু মুজিব হত্যা নয়, খুনিদের লক্ষ্য ছিল, মুজিব নেতৃত্বের কোনো চিহ্ন না রাখা। তবে দৈবাৎ বেঁচে গিয়েছিলেন দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, তারা ছিলেন জার্মানিতে। সৌভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী; আর সে কারণে খুনিদের বিচার হয়েছে। অর্থাৎ খুনিদের হিসাবে ভুল হয়েছিল। আসলে তারা বুঝতেই পারেনি বাংলাদেশে নারী নেতৃত্ব সম্ভব। আর তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের গতিমুখ ফিরিয়ে দেশটাকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বানাতে চেয়েছিল। হত্যা-পরবর্তী বেতারে খুনি ডালিমের ঘোষণাও তাণ্ডই ছিল। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশকে তারা পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল; যা সময়ের আবর্তনে হয়নি।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কাছাকাছি একটি দৃষ্টান্ত আছে। ১৮৫৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে ইংরেজ সৈনিক কর্নেল হডসন বাহাদুর শাহর চার রাজপুত্রকে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করেছিল। বেশ কিছুদিন পর ইংরেজ ইতিহাসবিদ ম্যালেসন ভারতে ইংরেজদের গৌরবগাথা নিয়ে ইতিহাস রচনা করার সময়ে হডসনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটা অপ্রয়োজনীয় এবং অপরাধ’ ছিল। খোদ ইংরেজ ইতিহাসবিদ তার স্বজাতি একজনের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন এভাবে। চারজনকে হত্যা করার জন্য যদি এমন মন্তব্য হয়, তাহলে ১৫ আগস্টের হত্যা সম্পর্কে কেমন মন্তব্য হওয়া উচিত?

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এমন হত্যাকাণ্ড? প্রশ্নের উত্তরের জন্য তথ্য-দলিল এত দিনে অপ্রতুল নয়। বিশদ কোনো আলোচনায় না গিয়ে চুম্বক কিছু বলা যেতে পারে। প্রথমত, আত্মস্বীকৃত খুনিরা হিমশৈলর শীর্ষভাগ ছিল, তারা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছিল মাত্র। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী ছিল, যাদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় ছিল। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর বড় অপরাধ ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির অনুঘটক হওয়া এবং দেশটিকে যেভাবে গড়ছিলেন। একাত্তরে মোশতাক, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর এবং মাহবুবুল আলম চাষী (গোঁড়া দক্ষিণপন্থি) মার্কিন যোগসাজশে মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে চেয়েছিল; কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের শক্ত ভূমিকার কারণে উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু বায়াত্তর থেকে ষড়যন্ত্র নতুন করে শুরু হয় এবং যুক্ত হয় সেনাবাহিনীর কর্নেল ফারুক-রশিদ (যারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি অনুচর হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল)। বায়াত্তর থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল তার প্রমাণ ২০০৫-এ অবমুক্ত মার্কিন দলিলে আছে; আর তখন থেকেই ফারুক ও রশিদ এবং যুক্তরাষ্ট্র সংযোগ স্থাপিত হয়, যা চলমান ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যা পর্যন্ত। একই দলিলে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার কথা আছে।

তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধু মুজাহিদুল সেলিমকে বলেছিলেন, ‘মোশতাক আমাকে কালকে কী বলেছে জানো? বলেছে এত সমাজতন্ত্র কইরো না, এত ধর্মনিরপেক্ষতা কইরো না। একটু আল্লাহ আল্লাহ করো, ব্যক্তি খাতকে গুরুত্ব দেও। ওকে আমি বলে দিছি, মোশতাক, তোর কথা আমি শুনলাম না। আমার দেশের কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, [তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য] আমি সমাজতন্ত্রের পথেই যাব, আমি ধর্মনিরপেক্ষতার পথেই যাব।’ বোধগম্য যে, বঙ্গবন্ধুকে না সরালে বাংলাদেশের গতিমুখ ফেরানো সম্ভব ছিল না।

চতুর্থত, বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্স জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে (৬-৯ সেপ্টেম্বও ১৯৭৩) যা বলেছিলেন, তাতে বিশ্বমোড়লদের হৃৎকম্প হওয়ার কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত-শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ এমন বক্তব্যের জন্য ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দিত করে সতর্ক করেছিলেন, আজ থেকে তোমাকে একটি বুলেট অনুসরণ করবে। ক্যাস্ত্রোর কথা মিথ্যা হয়নি।

দেশে ফিরে ১১ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু খবর পেলেন, চিলির অ্যালেন্দেকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি তখন বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘আমাকে হয়তো অ্যালেন্দের ভাগ্যবরণ করতে হবে।’ হয়তো নয়, তাই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশি-বিদেশি সতর্ককারীর অভাব হয়নি; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এক উত্তর- কোনো বাঙালি আমাকে মারবে না। যেমন : ৭৫-এর জুন মাসে তিনি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে বলেছিলেন, কোনো বাঙালি আমার দিকে বন্দুক তাক করলে তার হাত কেঁপে যাবে। উল্লেখ্য, ট্রিগার টিপতে গিয়ে খুনিদের হাত কাঁপেনি। কারণ তারা জন্মসূত্রে বাঙালি হলেও মন-মানসিকতায় পাকিস্তানি। কোনো বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে মারেনি।

উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু দেশের কুচক্রী মহল এবং বিশ্বের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী মোড়লদের কাছে হয়ে উঠছিলেন মূর্তিমান বিভীষিকা। কাজেই তার দিন ফুরিয়ে এসেছিল। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অনিবার্য ছিল। ষড়যন্ত্রই তার জীবন (৫৫ বছর ৪ মাস ২৯ দিন) অবসানের কারণ।

দেশে, সারা বিশ্বে এখন যে মুজিব-নান্দীপাঠ চলমান, তখন মুজিবহীন বাংলাদেশে স্মরণ করতে হয় মহাত্মা গান্ধীর ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে আইনস্টাইনের উক্তির শেষ বাক্যটি, ‘আগামী প্রজন্মগুলো সম্ভবত এটা বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে, এমন একজন মানুষ এ ধরণীতে বিচরণ করেছিল’। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, আগামী প্রজন্মও বিশ্বাস করবে যে, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের মাটিতে এক দিন বিচরণ করেছিলেন।

লেখক : চেয়ার অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close