দিদার বখ্ত

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

ফিরে দেখা- বাংলা ভাষা

বিকালে খেলাধুলা করে সন্ধ্যায় সিংদরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে অথবা বজ্র গম্বীর স্বরে ডাক দিলেন। সামনে যেতেই তিরিক্ষে মেজাজে বললেন, ‘তুমি এখুনি বাড়ি থেকে চলে যাও’। আমি জানতে চাইলাম কী হয়েছে? আব্বা আরো তিক্ষè স্বরে বললেন Where ever you go, your create unrest and problems. তুমি এই মূহর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। সঙ্গে সঙ্গে মাকে হুকুম করলেন, ‘ব্যাগণ্ডব্যাগেজ গুছিয়ে দাও।’

আমি প্রায় হতভম্ব। বুঝতে পারছি না কেন আব্বা এত ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে বলছেন। আমি সাহস করে জানতে চাইলাম, কলেজ তো ছুটি, সবে বাড়িতে এসেছি, আমি আবার কী করলাম যাতে এখুনি এই রাতেই আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। মাও অনুনয়ের সঙ্গে বললেন এই রাতেই তাকে কেন যেতে হবে, কাল সকালে না হয় চলে যাবে।

আব্বা তখন জোর দিয়ে বললেন, এই রাতেই ওকে যেতে হবে। কাল সকালবেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করা চলবে না। আমি দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেকে পুলিশ অ্যারেস্ট করবে এই আমি দেখতে পারব না।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, পুলিশ অ্যারেস্ট করবে কেন? আমি কী করেছি? আব্বা বললেন, বিকালে বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। তোমাকে থানায় নিয়ে যাবে বলে। পুলিশ আমাকে জানাল তোমরা তোমাদের স্কুল প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার তৈরি করছো। সরকারি বাধা নিষেধ আছে, ওরা শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছে। মিস্ত্রি বলেছেন, তোমার কথামতো সে শহীদ মিনার তৈরি করছিল। তাই পুলিশ তোমাকে অ্যারেস্ট করার জন্য বাড়িতে এসেছিল। তোমার বাড়িতে থাকা এক মুহূর্তে নিরাপদ নয়। তাই তোমাকে এখনি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। সাইকেল আছে তুমি সাইকেল নিয়ে এখনি কলেজ হোস্টেলে চলে যাও। দৌলতপুর পৌঁছাতে দু-তিন ঘণ্টা লাগবে, তাই দেরি না করে এখনি রওনা দাও।

আমি তখন পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। কলেজ ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি দীর্ঘপথ অতিক্রম করে গ্রামের বাড়ি তেঁতুলিয়ায় চলে আসি।

পরদিন সকালে প্রদীপ মজুমদারের (গোবিন্দ) সঙ্গে তালাবাজারে দেখা। দুজনে বসে আলাপচারিতায় শহীদ দিবস পালনের প্রসঙ্গ এলো। আর মাত্র ৫-৬ দিন পরই শহীদ দিবস। শহীদ দিবস কীভাবে তালাতে পালন করা হবে তাই নিয়ে আলাপ করছিলাম দুজন। এরপর তালা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্ররা আমাদের সঙ্গে এসে যুগ দেয়। আমরা তখন বাংলা ভাষার জন্য যেসব ছাত্র প্রাণ দিয়েছে তাদের স্মরণে কীভাবে শহীদ দিবস পালন করলে ভাষা শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে তার জন্য বিস্তারিত আলোচনা করলাম। প্রসঙ্গক্রমে স্কুলের ছেলেরা জানাল স্কুল প্রাঙ্গণে কোনো শহীদ মিনার নেই, কোথায় আমরা ফুল দিয়ে আমাদের সম্মান প্রদর্শন করব। ফুলেল অর্ঘ প্রদান করব।

তখনই আমাদের মাথায় আসে স্কুল প্রাঙ্গণে একটি শহীদ মিনার তৈরি করলে কেমন হয়। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত হলো কাল সকালে স্কুলে প্রধান শিক্ষকের কাছে অনুমতি নিয়ে আমরা শহীদ মিনার গাঁথা শুরু করব। ছোট আকারে প্রথম করব। এ বছর আমরা ফুলেল অর্ঘ দিয়ে শহীদদের প্রতি সম্মান জানাব। পরে বড় আকারে শহীদ মিনার করা যেতে পারে, এই বলে সেদিনের মতো আলোচনা শেষ করে সবাইকে বললাম, তোমাদের যার যেমন সংগতি আছে চাঁদা তুলে প্রাথমিক কাজ শুরু করব। পরে বাজার থেকে দোকানদারদের কাছ থেকে চাঁদা তুলব তারা নিশ্চয়ই আমাদের এই প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসবে এবং চাঁদা দেবে। আমরা শহীদ মিনার গড়ে তুলতে পারব।

পরদিন সকালে আমরা কয়েকজন তার মধ্যে প্রদীপ মজুমদার, সৈয়দ ঈসা, সৈয়দ কামেল বখত, কাজী আফরা, জালাল পাড়, কাজী জলিল মীর মনা, সবাই মিলে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করলাম। প্রধান শিক্ষক স্পষ্ট করে বললেন, এটা তোমাদের বিষয়, এ বিষয়ে আমি কোনো মতামত দেব না। বললাম- কোন জায়গায় শহীদ মিনার তৈরি করলে ভালো হয়, সেটা দেখিয়ে দিন। উনি বললেন, তোমরা যেখানে ভালো মনে করো সেখানেই তৈরি করো। আমি এ বিষয়ে কোনো মতামত দেব না। প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে এমন মন্তব্য শোনার পর আমরা কিছুটা হতাশ হলাম, কিন্তু হতোদ্যম হলাম না।

প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে বেরিয়ে এসে স্কুলের এক প্রান্তে আমরা শহীদ মিনারের জায়গা নির্ধারণ করলাম। স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রের বাবা রাজমিস্ত্রি। ওর নাম খুব সম্ভবত হাশেম। হাশেমও রাজমিস্ত্রির কাজ জানে। তাকে বলা হলো শহীদ মিনার গাঁথতে। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলো।

আমরা তখন তালাবাজার থেকে সিমেন্ট সংগ্রহ করলাম এবং একজনের ইটের বাটা থেকে ইট ও বালু সংগ্রহ করলাম। হাশেম খুবই উৎসাহ নিয়ে শহীদ মিনার গাঁথা শুরু করল।

দুপুরে খাওয়ার জন্য বাড়ি এসেছি। এরপর গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়েছি। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর আব্বার আদেশ এখুনি বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার। আমার আব্বা তখন তালা বি দ্য ইনস্টিটিউশনের স্কুল কমিটির সেক্রেটারি। তার ছেলেকে নিয়ে পুলিশি জামেলা হক এইটা তিনি চান না বলেই ওই রাতেই আমাকে বাড়ি ছেড়ে বি.এল কলেজের হোস্টেলে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। আব্বা আমাকে জানান, পুলিশ শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছে, মিস্ত্রিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সে পুলিশকে জানিয়েছে, আমার নির্দেশেই সে শহীদ মিনার তৈরি করার কাজ হাতে নিয়েছে। সে কারণেই পুলিশ আমাকে খুঁজছে। অগত্যা আমি সাইকেল নিয়ে ওই রাতেই বি.এল কলেজের উদ্দেশে রওনা দিই।

সাইকেল চালাতে চালাতে আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, সে সময়কার একুশে ফেব্রুয়ারির দিনের একটি ঘটনার কথা বারবার মনে পড়ছিল। সবে আমি ক্লাস সেভেনে উঠেছি। রাজনীতি আন্দোলন এসব বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমি প্রতিদিনের মতো যথারীতি একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে স্কুলে যাই। আমার গ্রাম থেকে স্কুল প্রায় ৪ কিমি দূরে। সবে বড় সাইকেলে করে যাতায়াত করি। স্কুলে পৌঁছানোর পর দেখি ছাত্ররা বিশেষ করে দশম শ্রেণির ছাত্ররা সবাই ক্লাসরুমের বাইরে বারান্দায়। অন্যান্য ক্লাসের ছেলেরাও কেউ ক্লাসে কেউবা বারান্দায়। সমগ্র পরিবেশ জুড়ে কেমন একটা থমথমে পরিস্থিতি।

আমি স্কুলের গেট রুম পেরিয়ে বারান্দায় উঠে ক্লাসরুমে যাব, এমন সময় দশম শ্রেণির এবং নবম শ্রেণির ছাত্ররা আমার পথ রোধ করল। বলল, আমরা আজ ক্লাস করব না। কারণ নূরুল আমিন সরকার ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়েছে। ছাত্রদের দাবি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে। কিন্তু সরকার তা চায় না তারা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করতে চায়। উর্দু যদি রাষ্ট্রভাষা হয় তাহলে আমরা আমাদের ভাষা বাংলায় কথা বলতে পারব না। মাকে মা বলে ডাকতে পারব না। ছাত্ররা তাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন করছিল। ছাত্ররা যখন মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিল, সরকারি নির্দেশে পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। কয়েকজন ছাত্র নিহত হন। তার প্রতিবাদে সমগ্র দেশে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শোক দিবস পালন করা হয়। আমরাও আজ ক্লাস বর্জন করব। শোক দিবস পালন করব। তাই আমরা ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।

পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যা হয়েছে, আমরা বাংলায় কথা বলতে পারব না। এ কথা শুনে আমি সপ্তম শ্রেণি ছাত্র হলেও মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সমস্বরে চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিন গদি ছাড়’। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, আমরা এখুনি ছাত্র হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় প্রসেশন করব। একটু বক্তৃতার ঢঙে আমি বললাম, ভাইসাব ছাত্র হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত, রাষ্ট্রভাষা বাংলা না করা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।

আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ফুলিঙ্গের মতো ছাত্রদের মধ্যে যেন আগুন জলে উঠল। দশম শ্রেণির ছাত্ররা আমাদের বড় ভাই, সবাই তখন চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিন গদি ছাড়’। স্লোগান দিয়ে রাস্তায় মিছিল করার জন্য স্কুলের বাইরে চলে এলাম। তালার বুকে এর আগে কখনো কোনো প্রতিবাদ মিছিল হয়নি। শুধু নির্বাচনের সময় মিছিল করতে দেখা গেছে। এটা নির্বাচনের মিছিল নয়, এটা ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রদের অগ্নিঝরা মিছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চল, সুন্দরবনের সন্নিকটে অনুন্নত গ্রামীণ জনপথ সেদিন ছাত্রদের জঙ্গি মিছিলে সরব হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তালাবাজারের সব দোকানঘর বন্ধ হয়ে গেল। ছাত্র-মিছিলের সঙ্গে পথচারীরাও মিছিলে যোগ দিয়েছিল সেদিন। প্রকম্পিত হলো অনুন্নত এই গ্রামীণ জনপদ।

মিছিল শেষে আবার আমরা স্কুল প্রাঙ্গণে ফিরে আসি। এর কিছুক্ষণের মধ্যে স্কুলের হেডমাস্টার জ্ঞানেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী ছাত্রদের মধ্য থেকে আমাকে, আবদুল হালিম, মোশাররফ এবং জালাল পাড়কে তার রুমে ডেকে পাঠালেন। আমরা গেলাম, দেখি স্কুলের অফিসরুমে চারজন সিপাহি। হেডস্যার জানালেন, তোমাদের থানায় যেতে হবে, দারোগা সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। উনি বললেন, তোমরা যাও আমরা কয়েকজন শিক্ষকও যাব, স্কুলের সেক্রেটারি সাহেবকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, উনিও এসে পড়বেন, তোমাদের ভয় নেই। আমরা দেখব যাতে তোমাদের কোনো বিপদ না হয়। আমরা থানায় গেলাম। দারোগা সাহেবের পাশের ঘর পুলিশ ব্যারাক, সেখানে আমাদের বসতে বলা হলো।

কিছুক্ষণ পর দেখি স্কুলের শিক্ষক বিন্দু এসে পৌঁছালেন। এর পরপর আমার আব্বা অর্থাৎ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি এসে পৌঁছালেন।

আমার আব্বা থানায় ঢুকেই বেশ জোরের সঙ্গে দারোগা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে দারোগা সাহেব? জরুরিভাবে তলব করে আমাকে কেন থানায় ডেকেছেন? দারোগা সাহেব বললেন, আপনি স্কুলের সেক্রেটারি, ছাত্ররা আজ সরকারি নির্দেশনার বাইরে রাস্তায় মিছিল করেছে, স্লোগান দিয়েছে। ওদের সম্পর্কে কী ব্যবস্থা নেব তার জন্য আপনার সঙ্গে আলাপণ্ডআলোচনা করার জন্য আপনাকে ডেকে নিয়ে এসেছি। স্কুলের শিক্ষকরাও আছেন আমার এখানে, আপনারা বলুন কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে ওদের বিরুদ্ধে?

আব্বা অভিযোগ শুনে বললেন, ওদের ধরে নিয়ে এসেছেন, ওদের অপরাধ কী? ওরা কি চুরি করেছে? নাাক ডাকাতি করেছে? নাকি লুটপাট করেছে? মারামারি করেছে? কী করেছে ওরা? যার জন্য ধরে নিয়ে এসেছেন।

দারোগা সাহেব বললেন, মিছিল করাই তো বেআইনি। সরকারি বিধিনিষেধ আছে।

আব্বা বললেন, আমার দৃষ্টিতে ওরা কোনো অন্যায় করেনি। ওরা ছাত্র হত্যার বিচার চেয়েছে, আর রাষ্ট্রভাষা বাংলা চেয়েছে। এটাই তো ওদের দাবি। আপনি যদি মনে করেন এটা রাষ্ট্রদ্রোহী তাহলে ওদের চালান করে দিন। কিন্তু মনে রাখবেন ওদের চালান করলে ‘রাজবন্দি’ হিসেবে চালান করতে হবে। এই বলে আব্বা যখন বেরিয়ে আসতে চাইলেন, তখন দারোগা সাহেব বললেন, আমি ওদের চালান দিতে চাই না। আপনারা অভিভাবক। আপনাদের কাছে ওদের দিতে চাই। ওরা যেন আর এমন কাজ না করে।

শিক্ষকসহ ছাত্ররা থানার বাইরে বেরিয়ে এলে জড়ো হওয়া লোকজন উল্লাসে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমি গদি ছাড়।’

সাইকেল চালাতে চালাতে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ায় শিহরিত হচ্ছিলাম। আমাদের রাজবন্দি হিসেবে আখ্যায়িত করতে হবে শুনে আমার ক্ষুদিরামের কথা স্মরণ হলো, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’। এ গান দেশপ্রেমের এক অপূর্ব অনুপ্রেরণা। রোমাঞ্চিত হয় সব অনুভূতি, বুক চিতিয়ে গুলির সামনে দাঁড়াতেও কুণ্ঠাবোধ হয় না।

১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা আবার নতুন করে ১৯৬১ সালে ঘটতে চলেছিল আমার জীবনে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রাজনীতির কিছুই বুঝি না, তবুও আবেগতাড়িত হয়ে রাস্তায় মিছিল করেছিলাম, অ্যারেস্টও হয়েছিলাম। ছাত্র হত্যার বিচার চাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই- এই প্রবল আবেগময় দুই ইস্যু ধীরে ধীরে মহিরুহ হয়ে বিশাল আন্দোলনে রূপ নেয় পরে। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের বাতিলের আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, এক নদী রক্তের বিনিময়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, পৃথিবীর মানচিত্রে লাল সবুজের পতাকাবাহী একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।

বর্ষ পরিক্রমায় ফেব্রুয়ারি মাস এলেই পুরোনো দিনের সেই আন্দোলনের স্মৃতিগুলো মানসপটে ভেসে ওঠে। ১৯৬১ সালে তালায় স্কুল প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার করতে পারিনি। সেদিন রাতে কলেজ হোস্টেলে এসে অর্ধভুক্ত অবস্থায় রাত্রিযাপন করেছিলাম। পরের দিন খুলনা শহরে ছাত্র বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। মিলিত হয়েছিলাম ছাত্র বন্ধুদের সঙ্গে বিশেষ করে এরফান উল্লাহ খান, আতিউল ইসলাম, হাসান রুমি, কাজী কামাল উদ্দিন, শওকাত, মাসুদুল হক, আবদুল মান্নান, ইউনুছ আলী এবং আরো কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

এখানেও শহীদ মিনার নির্মাণ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। শহীদ হদিস পার্কের (জিন্নাহ পার্কে) ভেতর শহীদ মিনার তৈরি করার কথা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেই মতে, তৃপ্তি নিলয়ে (রাজনৈতিক নেতাদের আড্ডার এবং খাবারের দোকান) গেলাম সন্ধ্যার সময়। ন্যাপের নেতা অ্যাডভোকেট আবদুল জব্বার, নুরুল ইসলাম, আবদুল জলিল, ফেরদৌস আহমেদ এবং আরো কয়েকজন বড় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাপণ্ডআলোচনা হয়েছিল, শহীদ মিনার নির্মাণ প্রসঙ্গে। নেতাদের সঙ্গে আলাপের উদ্দেশ্য- যদি সরকার থেকে কোনো চাপ আসে আমরা সামাল দিতে পারব না। তাই নেতাদের সঙ্গে আলাপ করা। এদের সমর্থন পেয়ে আমরা শহীদ হদিস পার্কের একদিকে শহীদ মিনার নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানেও সেই একই বিড়ম্বনা। পুলিশি বাধা অতিক্রম করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু ওই বছর আমরা ভাবগম্বীর পরিবেশে শহীদ দিবস পালন করেছিলাম। হাজারো ছাত্রের প্রভাতফেরিসহ ‘আমার ভাইয়ে রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ এই অমর গানটি সেদিন খুলনা শহরের বুকে এক বেদনাবিদুর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।

আজ একান্তে বসে সেদিন গুলির কথা স্মরণ করি। সেদিন আমাদের শহীদ মিনার নির্মাণ করতে দেয়নি পাকিস্তান সরকার। পায়ের তলায় পৃষ্ট করতে চেয়েছিল আমাদের প্রাণের ভাষা ‘প্রাণ বাংলা ভাষা’। ভ্যাগের কী পরিহাস, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হলো বাংলাদেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যানত হত্যা, শাসন-শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন সমূলে উপড়ে ফেলে এক নদী রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি একটি গর্বিত দেশ ‘বাংলাদেশ’।

শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য পাক-সরকার যে, নির্যাতন, জেল, জুলুম, অত্যাচার, হত্যাজজ্ঞ চালিয়ে ছিল, সেই শহীদ মিনার আজ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয়েছে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়। অনেক বড় শিল্প-কল-কারখানার অফিস-আদালতের প্রাঙ্গণেও শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে শহীদের প্রতি ফুলেল অর্ঘ দিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য।

আজ রা¤্রভাষা বাংলা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাণ্ডই নয়, বাংলা ভাষা পৃথিবীর মানচিত্রে সব দেশেই রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজ বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। সত্য সঠিক পথের আন্দোলন অবশ্যই জয়ী হবেই হবে।

লেখক : সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close