গোলাম কবির

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

বাংলা ভাষা হোক বিজ্ঞানভিত্তিক কোষাগার

আগ্রাসন সভ্যতাণ্ডসংস্কতি নির্মাণ অপেক্ষা ধ্বংস করেছে বেশি। পৃথিবী থেকে বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে ক্ষমতালিপ্সু আগ্রাসীদের দুর্বৃত্তায়নে। আগ্রাসীরা যে অঞ্চল গ্রাস করেছে, সেখানে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছে। অদূর ইতিহাস বলছে, বাংলা তথা ভারতে আরব, মোগল, পাঠানসহ বিভিন্ন শাসক সম্প্রদায় এসেছে।

তাদের কারো কারো ধর্মীয় ভাষা আরবি হলেও অনেকের সংস্কৃতির বাহন ফারসি। বাংলার মানুষ উন্নত সংস্কৃত ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে পেয়েছে ফারসি ভাষার ভাবসম্পদ। তাই তো দেখা যায়, চতুর্দশ শতকে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ কবি হাফিজকে তার দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আর কবি জয়দেব লক্ষ্মণসেনের দরবারকে গীতগোবিন্দমের রসে ভাসিয়ে দিয়েছেন। প্রথম দিকে ‘পুরাণ’ কিংবা ‘রামচরিত’ বাংলা ভাষায় রূপান্তরকারীদের রৌরব নরকে যাওয়ার ফতোয়া দিলেও পরবর্তী সময়ে তেমন সাংঘর্ষিক হয়নি। বাংলা ভাষা চলছিল তার নিজস্ব গতিতে। সেখানে সংস্কৃত এবং ফারসি শব্দ আসন করে নিয়েছে নীরবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা দখলের পর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে (১৮০০) সিভিলিয়ানদের বাংলা ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্যে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরা কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। সেখানে কেরির ‘কথোপকথন’ ব্যতীত অন্যগুলোতে অধিক সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ এর প্রায় পৌনে এক শতাব্দী আগে কবি ভারতচন্দ্র বলেছিলেন, ‘যাবনী মিশান’ শব্দ ব্যবহার না করলে ভাষায় ‘প্রসাদগুণ’ থাকবে না ও ‘রসালো’ হবে না। এতদসত্ত্বেও বাংলা ভাষা তার নিজস্ব গরিমায় এগিয়ে চলেছিল। এরই মধ্যে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে রাজভাষা ফারসি থেকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত হলেও বাংলা ভাষার গতি রুদ্ধ করতে পারেনি। ইংরেজরা ক্ষমতা দখলের প্রায় আট দশক পরে ইংরেজিকে রাজভাষায় রূপান্তরের পদক্ষেপ নেয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সহযোগিতায় পূর্ব বাংলার মানুষের অবদান অতুলনীয়। পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যাধিক্যকে গ্রাহ্য না করে সদ্যভূমিষ্ঠ দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার ঘোষণা হলো বছর না ঘুরতেই। ঘোষকরা ছিলেন উদ্বাস্তুদের প্রতিনিধি। তারা ভারত থেকে পাকিস্তানে হিজরতকারী। বাংলার তরুণরা সেই ঘোষণা অবনত

মস্তকে মেনে নেয়নি বলে ভাষার লড়াইয়ের সঙ্গে স্বাধিকার চেতনা দানা বেঁধে ওঠে।

যেকোনো ভাষায় নতুন নতুন শব্দ সংযোজন ঋণাত্মক নয় ধনাত্মক, যদি তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়, তবে ভাষাকে শব্দভা-ারে সমৃদ্ধ করে। বাংলা ভাষায় বহু ভাষার শব্দ মিশে গেছে। সেগুলোর জন্মপরিচয় নিয়ে কেউ বিতর্কে নামে না। তাই বলে শিকড় উপড়ে ফেলা! অন্যকে খুশি করার জন্য অপর ভাষার আমদানি কতখানি আত্মবিধ্বংসী, তা আত্মসর্বস্ব শিকড়হীনরা বুঝবে কিভাবে! পূর্ব বাংলার মানুষ যথার্থই বুঝেছিল, আত্মপরিচয়হীন জাতি অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই তারা পিছু হটেনি। হটেনি বলেই ‘মা’কে ‘মা’ বলার মৌলিক অধিকারের পথ ধরে দেশের স্বশাসনের অধিকার রক্তের দামে কিনেছে।

জন্মকাল থেকে বাংলা ভাষা স্বঘোষিত উচ্চবর্গীয়দের কোপের মুখে পড়েছে। মাতৃভাষায় সৃজনশীলরা দমেননি। তথাকথিত কুলিনদের কথিত ব্রাত্যজনরা বাধ্য হয়ে ছেড়েছেন দেশ; কিন্তু ভাষা ছাড়েননি। সেই ভাষা পাকিস্তানিদের চক্ষুশূল হলো। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালি নামের কলঙ্ক কিছু তাঁবেদার অপপ্রচার শুরু করল। বাংলা ভাষার ধারণক্ষমতা সীমিত, তাই উচ্চভাব বা চিন্তার রূপায়ণ সেখানে কঠিন। এসব অতি জ্ঞানপাপী কী বোঝেন, ভাবচেতনা আসলে মনোজগতে ধারণ করতে হয়। তারপর বহুকর্ষণে ভাষা হয়ে জন্ম নেয়। প্রাণিকুলসৃষ্ট নিজেদের ভাষা তারা বোঝে। সৃষ্টির সেরা মানুষের উপলব্ধি প্রকাশের ভাষা সেরা হবে এবং উপলব্ধিই সহজ হবে, তা স্বতঃসিদ্ধ। তাই নিয়ে কোন্দল। এর মূল কারণ ছিল শোষণের পথ খোলা রাখা।

বাংলা ভাষার ধারণশক্তি অপরিসীম। যেকোনো ভাবনায় যেকোনো ধ্বনি উচ্চারণের বিস্তৃত বিচরণ ক্ষেত্র বাংলা ভাষা। অবশ্য এই শক্তি ফারসি এবং সংস্কৃত ভাষায়ও আছে। অভিজাত বলে কথিত অন্য কোনো ভাষায় নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ঠাট্টা, গাঢ়, ঝড়ঝঞ্ঝা ইত্যাদি শব্দ এবং প্রকৃতির ও কলকব্জার ধ্বনিগুলোও বাংলা ভাষায় উচ্চারণ করা যায়। অবশ্য উর্দু-হিন্দিতে উল্লিখিত ধ্বনি উচ্চারণের সুযোগ আছে। তবে মনে রাখতে হবে, ভাষা দুটি ফারসি-সংস্কৃতের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্বকে গৌণ করে দেখার অবকাশ কতটুকু! যারা বাংলা ভাষাবিরোধী, আসলে তারা মতলববাজ। এ দেশের কিছু জ্ঞানপাপী ‘সুধারসে’ ভরা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে এসেছেন। উনিশ শতকে মধুসূদন ঠেকে জেনেছিলেন বাংলা ভাষার খনিতে কী পরিমাণ মণি-মুক্তা সঞ্চিত আছে। বিদ্যাসাগর তো বাংলা ভাষা-অন্তপ্রাণ ছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ’ শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন।

মাতৃভাষার মর্যাদা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ। তিনি বুঝেছিলেন, মাতৃভাষা বাংলাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে বাংলার মানুষের মুক্তি পূর্ণতা পাবে না। স্বাধীনতার মাধ্যমে মানবমঙ্গল অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের মৃত্যুগুহা থেকে ফিরে এসে জাতির কল্যাণে যেসব নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন, সেগুলোর অন্যতম রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন। বঙ্গবন্ধু বুঝতেন, ‘মাতৃদুগ্ধসম’ মাতৃভাষা বাদ দিয়ে জাতির মুক্তি দূরের কল্পনা। শূন্য রাজকোষ আর ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যে প্রশাসনে বসে সাড়ে তিন বছরে অনেক কিছুর খোলনলচে পরিবর্তনে সচেষ্ট থেকেছেন। জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছেন।

দীর্ঘকালের গোলামির মানসিকতা আমাদের মুক্তির দিগন্তকে বারবার কলঙ্কিত করেছে। তাই তো দেখি, পরদেশি প্রভুদের পদলেহী আর আত্মপরিচয়হীনরা বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে সরিয়ে দিয়ে নতুন করে ইংরেজির সঙ্গে অপর ভাষাকে আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের দুর্বল মেরুদণ্ড ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে বিপুল সমারোহে। এ যেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিশোধ নেওয়া। কিম্ভুতকিমাকার আজব সীমানার পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব বাংলায় যতটুকু বাঙালিয়ানা অবশিষ্ট ছিল, তা মুছে ফেলার নিবিড় চক্রান্ত। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজ-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ধুম পড়ে যায়। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ধুয়া তুলে বাংলা ভাষাবর্জিত ব্যাংক খুলে কিছু মেধাবীকে অনেক টাকা বেতন দিয়ে আকৃষ্ট করে। তাতে ফল কতটুকু হয়েছে! ইংরেজি ভাষায় আমরা কতখানি পারদর্শী হয়েছি তা গবেষণার বিষয়; কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা যে ভাসমান হওয়ার উপক্রম, তা ভেবে দেখার বোধ করি সময় হয়েছে।

আসলে আমাদের দাসত্বের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। দাসত্বের একটা সুবিধা হলো, প্রভুর উচ্ছিষ্ট ভোগ করা যায়, বিফল পরিণতির দায় নিতে হয় না। মাতৃভাষা ‘ইনস্টিটিউট’ গড়তে কোমর বেঁধে নামি (পদণ্ডপদবির লোভে); কিন্তু উচ্চতর বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে বাংলা ভাষায় সহজ ও সুলভ করা থেকে বিরত থাকি। এটা কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির কাম্য নয়। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তনের প্রথম যুগে সেটা মুক্তবুদ্ধি চর্চার পীঠস্থানে পরিণত হয়ে ওঠে। সেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও ভাষার পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশ্বের জ্ঞানভা-ারের অনেক কিছু তাদের মাতৃভাষায় অনুবাদ করে ‘হালাকুণ্ডচেঙ্গিস’ বা হালের ‘ক্লিনটন-ব্লেয়াররা’ তা ধ্বংস করলেও যে শিকড় জ্ঞানতাপসরা প্রোথিত করেছিলেন, তা সুদীর্ঘকাল মাতৃভাষার জয়গান করে চলেছে। মাতৃভাষা যেসব উপলব্ধির ধারক, তা আঠারো শতকের কবি রামনিধি গুপ্ত বুঝলেও আমরা বিদেশি ভাষার দাপটে ভুলতে বসেছি। রামনিধি বুঝেছিলেন :

‘নানান দেশের নানান ভাষা,

বিনে স্বদেশি ভাষা পুরে কি আশা’

‘একুশ’ আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে এবং অধিকার আদায়ে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছে। ২০২১ সালের ‘করোনা’ বিপর্যস্ততাকে তুড়ি মেরে আমরা ২০২২ সালে নতুন করে উদ্দীপ্ত হয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে বিজ্ঞানভিত্তিক সৃষ্টির কোষাগার নির্মাণে ব্রতী হতে পারলে বাংলা ভাষার যথার্থ সম্মান দেওয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close