বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলে ধন্য হয়েছি : পাভেল রহমান
পাভেল রহমান দেশের প্রখ্যাত একজন আলোকচিত্রী। তিনি শৈশব থেকে ছবি তুলতেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল তার ছবি তোলার পথচলা। দেশ-বিদেশে তার ক্যামেরায় তোলা ছবি সাড়া জাগিয়েছে। তিনি আলোচিত হয়েছেন একজন আলোকচিত্রী হিসেবে। প্রতিদিনের সংবাদের পক্ষে তার মুখোমুখি হয়েছেন জিনাত জান কবীর
তার কাছে জানতে চাই আলোকচিত্রী হয়ে ওঠার গল্প। তিনি সহজ-সরলভাবে বলতে থাকেন তার ছবি তোলার সেসব গল্প।
কথা বলতে বলতে তিনি বলেন, বাবার একটি ক্যামেরা ছিল। ছোটবেলায় বাবার ক্যামেরা দেখে আমার ছবি তোলার শখ জাগে। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। মনের দিক দিয়ে ছিলেন উদার প্রকৃতির। বাবার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে শুরু করি। এভাবেই আমি আলোকচিত্রী হয়ে উঠি। আমি সেই কিশোর বয়সে ১৯৭০ সালে উড়ির চর গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের ছবি তুলে প্রশংসা অর্জন করেছিলাম। এমনিভাবে বিভিন্ন সময়ে অনেক দুর্লভ ছবি তোলার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
পাভেল রহমান বলেন, আমি ক্যামেরা হাতে কোথাও গিয়ে খালি হাতে ফিরিনি। ক্যামেরায় বন্দি করেছি অনেক দুর্লভ ছবি। এজন্য পত্রিকা অফিসের কর্তৃপক্ষ আমাকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন। আবার অনেকে ঈর্ষাও করেছে। বলতে গেলে আমি একজন সৌভাগ্যবান আলোকচিত্রী। মাত্র ১৭ বছর বয়সে আমি বঙ্গবন্ধুর গেঞ্জি পরা ছবি তুলেছি। এ কারণে সিনিয়ররা খুব ঈর্ষা করতেন।
তিনি আরো বলেন, নূর হোসেনের ছবি তোলার পরও অনেকে মনে মনে আমাকে আড় চোখে দেখতেন। কেননা, নূর হোসেন তার বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ এই স্লোগান লিখে রাজপথে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ সময় ছবিটি আমি প্রকাশ করতে পেরেছিলাম আর কেউ এই ছবিটি প্রকাশ করতে পারেনি। আমার চোখ দিয়ে যা দেখেছি তা আমি ক্যামেরার ফিতায় বন্দি করেছি। সেসব ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। দেশের জনগণ দেখে আপ্লুত হয়েছে। আবার ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের অ্যাকশনে পড়েছি।
আলোকচিত্রী জানান, আমার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছি। তার সান্নিধ্য পেয়েছি। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধু ও তার পারিবারিক ছবি তুলতে পেরেছি, সেজন্য নিজেকে ধন্য মনে করি। ছবি তোলার কারণেই বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল আবাহনীর সঙ্গে আমাকে কাজ করার সুযোগ করে দেন। তিনিই আমাকে বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলার সুযোগ দিয়েছিলেন। সে কারণে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে রাতেও যেতে পেরেছি আবার সকালেও যেতে কোনো বাধা ছিল না।
পাভেল রহমান বলেন, তবে আমি বেশিদিন বঙ্গবন্ধুকে পাইনি। আফসোস হয় আমি যদি তাকে আরো বেশিদিন পেতাম তাহলে আরো ছবি তুলতে পারতাম।
বঙ্গবন্ধু খুব সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। টিভি পর্দায় কিংবা অন্য জায়গায় যেভাবে দেখেন আমি সেভাবে দেখিনি। মিটিং-মিছিলে সেভাবে আমার ছবি তোলা হয়নি। তবে আমার সুযোগ হয়েছিল তার বাড়িতে গিয়ে এবং গণভবনে তার ছবি তোলার। আমার তোলা ছবিতে তার পারিবারিক জীবন উঠে এসেছে। হাসিনা আপা-রেহানা আপার ছবি। বিশেষ করে কামাল ভাইয়ের বিয়েতে আমি অনেক ছবি তুলেছি। জানান তিনি।
আলোকচিত্রী বলেন, গণভবনে বঙ্গবন্ধু মিটিং করছিলেন। তখন আমি ছবি তুলি। ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বক্তৃতা বন্ধ করে আমার দিকে তাকালেন। তখন আমি চুপ করে ছিলাম। আবার যখন বক্তৃতা শুরু করেন তখন আমি আবার ছবি তুলি। তখন আবার বঙ্গবন্ধু চুপ হয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু চুপ করে থাকায় পুরো মিটিংয়ের সবাই চুপ হয়ে গেলেন। তখন বঙ্গবন্ধু চোখে চোখ রেখে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘দেখো, এই ছবিটা তোমার দারুণ হবে।’ তখন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ছবির প্রশংসা পেয়ে গেলাম। এটা জীবনের অনেক বড় পাওয়া। কামাল ভাইয়ের বিয়েতে বঙ্গবন্ধু খালাম্মাকে (বেগম মুজিব) রং লাগিয়ে দিচ্ছিল। বেশ রসিকতা করছিলেন। তিনি বেশির ভাগ সময় জেলে ছিলেন, তেমন আনন্দ করার সুযোগ পাননি। কামাল ভাইয়ের বিয়েতে তিনি বেশ আনন্দ উপভোগ করেছেন। তবে তিনি নিজ থেকে আসেননি। আমরা গিয়ে তাকে অফিস থেকে নিয়ে এসেছি হলুদের দিন।
পাভেল রহমান বলেন, বিয়ে উপলক্ষে ১৩ জুলাই কামাল ভাই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার আয়োজন করছিলেন। সে কারণে আমি সেদিন তার বাড়িতে যাই। সেদিন নিচে নিরাপত্তারক্ষী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কোথায় যাব। আমি বলি কামাল ভাইয়ের রুমে যাব। আমি সিঁড়ি দিয়ে যতই ওপরে উঠছি, ততই আমি ওপরে ওঠার সময় অ্যারি মোডের গন্ধ পাই। এই গন্ধ আমি চিনতাম কারণ আমার বাবাও এই পাইপ টানতেন। এই গন্ধ আমি ছোটবেলা থেকেই পরিচিত ছিলাম। সে কারণে আমি বুঝতে পারি বঙ্গবন্ধু এখন বাড়িতেই রয়েছেন। তখন তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন। তিনি বাড়িতে আছেন কেউ আমাকে অ্যালার্ট করেনি। আমি সিঁড়ি দিয়ে যতই ওপরে যাচ্ছি ততই গন্ধের তীব্রতা বাড়ছে। আর আমি ভাবছি বঙ্গবন্ধু কি তাহলে ছাদে অবস্থান করছেন। ছাদে উঠে আমি ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি তিনি সেখানে নেই। সামনে তাকিয়ে দেখি তিনি লুঙ্গি পরে পা ভাঁজ করে বসে আছেন। ঠিক সন্ধ্যার সময় ফ্ল্যাশ দিয়ে আমি ছবি তুলি। ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার দিকে ঘুরে তাকালেন এবং উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন, ‘কে-রে! কে-রে? তুই আমার ছবি তুললি?’ বঙ্গবন্ধু আমাকে চেনেন। তার পরও এই কথা বলায় আমি ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন হারুন ভাই বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আমাদের পাভেল আপনার ছবি তুলেছে।’ তখন বঙ্গবন্ধু আমার দিকে ঘুরে বললেন, ‘তুই চিনিস আমি কে? এ কথা শোনার পর আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। এরপর মাথা উঁচু করে চোখে চোখ রেখে তার মতো কণ্ঠস্বর করে বলি, হ্যাঁ, আমি চিনি। আপনি বঙ্গবন্ধু। বলা মাত্রই তিনি বললেন, আমি কি শুধুই বঙ্গবন্ধু? আমি তো দেশের প্রেসিডেন্টও। তখন আমি চিন্তা করি তিনি আবার কবে প্রেসিডেন্ট হলেন। আমি ভাবছি প্রেসিডেন্ট কি তাহলে প্যান্ট-শার্ট-টাই পোশাক পরে ছবি তুলেন! ঠিক আমি বুঝতে পারছিলাম না। তিনি কি তাহলে খুব রাগ হয়েছেন। তিনি বেশ ভারী কণ্ঠে বললেন, ‘তোর শাস্তি হবে। যখন বলছেন শাস্তি হবে, তখন আমার হাত-পা কাঁপা শুরু হয়েছে। এখন কি তাহলে আমার ক্যামেরা কেউ নিয়ে যাবে, নাকি ফিল্ম কেড়ে নিয়ে যাবে? নাকি আমাকেই ধরে নিয়ে যাবে। তখন আমি ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে কামাল ভাইকে খুঁজছি, আর ভাবছি কে বাঁচাবে এখন আমাকে। তখন বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার ক্যাপ্টেন শরিফ আজিজকে ডেকে তিনি বললেন, ‘শরিফ আমার শার্টটা নিয়ে আয় তো।’ আমি ভাবছি, শার্ট পরে শাস্তি দেবেন। এটা কেমন শাস্তি! চেয়ে দেখি বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হওয়া মাত্রই শার্ট গায়ে পরতে পরতে তিনি বললেন, ‘তোর শাস্তি হলো তুই এবার আরেকটা ছবি তুলবি। এটাই তোর শাস্তি।’ এমনই মজা করতেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু মানুষ হিসেবে খুব সহজ-সরল ছিলেন। শুধু তাই নয় আচার-আচরণে, কথা-বার্তায়, পোশাক-পরিচ্ছদে ছিলেন খাঁটি বাঙালি। বাসায় তিনি লুঙ্গি- গেঞ্জি পরতেন। তাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এজন্য নিজেকে খুব গর্বিত মনে করি। বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক অনেক ছবি আমি তুলতে পেরে ধন্য মনে করি। সেসব ছবি কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।
"