reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৫ আগস্ট, ২০২০

এক দিন বঙ্গবন্ধু

সৈয়দ ইকবাল

দুই হাত তুলে জিকির করার মতো লাফাতে-লাফাতে গজা মিঞা চিৎকার করে উঠল, মাইরা দিছে! শেখ মুজিবেরে মাইরা দিছে! পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

গজা মিঞার লম্ফঝম্ফ করা জায়গাটি ধূপখোলা মাঠের পুব কোণে, দীননাথ সেন রোডের শেষ বাড়িটি। মূলবাড়ির বিরাট অংশ থেকে কিছুটা দূরে ছোট্ট ঘরটিতে মান্নান হুড়মুড় করে খাটে উঠে বসল। মামুন তখনো ঘুমাচ্ছে। মামুন তার যুদ্ধদিনের বন্ধু, আগরতলার কাছাকাছি হরিণা ক্যাম্পে থাকতে তারা দুজন খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে। পরস্পরের জন্য মরতেও দ্বিধা করবে না, এমন একটা অনুভূতি প্রায় দুজনের মধ্যে খেলে বেড়াত।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল, দুজনের কেউ মরল না। মান্নান ফিরে গেল চাটগাঁ, মামুন ঢাকায়।

বাড়ি ফিরে মান্নান বুঝল সারা দেশের মতো তারও সব তছনছ হয়ে গেছে। বাবা ছাড়া তার কেউ বেঁচে নেই আর বাবা সেই যুদ্ধের মধ্যেই আবার বিয়ে করে বউ ঘরে তুলেছেন। মান্নান সব শুনে একবার শুধু বাবার সঙ্গে দেখা করল, বাড়িতে আর ফিরে গেল না।

ঢাকা ফিরে ঢুকে গেল পার্টির কাজে। বছর কয়েক ঘুরে গেলেও সে পার্টির যুবক দলের মাঝারি কর্মীই রয়ে গেছে।

মাঝারি শ্রেণির হলেও সে নেতাদের খুব প্রিয়, বিশেষ করে যেসব নেতা সামাজিক যত কর্তব্য প্রায় সুকৌশলে এড়িয়ে যান। আখের গোছাতে তারা এত ব্যস্ত থাকে যে, সময়ই পান না। তবু যতই ব্যস্ততা থাক জায়গায়-জায়গায় নানা রকম অনুষ্ঠানে আর সভায় বক্তৃতা তাদের দিতেই হয়। মান্নানের ওপর ভার পড়ে অনুষ্ঠান আর সভার শ্রোতার শ্রেণি বুঝে বক্তৃতা লিখে দেওয়ার। মান্নান আসলে অত সব বাছবিচার করে না। ওপরতলা থেকে কাজ দিলে লিডারের কাজ ভেবে রাত-দিন এক করে কাজ সেরে দেয়। আসলে সে সব সময় কাজ চায়, কাজে ডুবে থাকতে পারলেই তার মনে হয় শান্তিতে আছে। তার চোখের সামনে পার্টি করার নামে, দেশের নামে, এমনকি বঙ্গবন্ধুর নামে নিজ নিজ স্বার্থের ষোলোআনা গুছিয়ে নিচ্ছে সবাই। মান্নানের ওসব ব্যাপার নিয়ে ভাবতেও খারাপ লাগে। বঙ্গবন্ধু তার খুব প্রিয় মানুষ। একবার ঝির-ঝির বৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে দলের অনেকের সঙ্গে লাইন দিয়ে সালাম করতে গিয়েছিল সে। কত জায়গা থেকে কত লোক এসেছে, সেই ভোররাত থেকে লাইন ধরে মালা আর ফুল দিয়ে যাচ্ছে লোক, তা-ও বিশাল লাইনের যেন শেষ নেই।

একসময় মান্নান বঙ্গবন্ধুর সামনে এসে দাঁড়াল, হাতে ফুল নেই, মালা নেই। বৃষ্টিতে জামা-প্যান্ট ভেজা, চুল ভিজে মাথায় লেপ্টে আছে। এতক্ষণ তার মোটেও শীত করছিল না, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়াতে তার ভেতরটা কেঁপে উঠল, শীত-শীত করতে লাগল। আর তখন মাথা নত করে পা স্পর্শ করল। মাথা তোলার আগেই তিনি হাত রাখলেন, চুলে আঙুল ডুবিয়ে ভরাট গলায় বলে উঠলেন, ‘দেখি! দেখি, ছেলেটার মুখটা দেখি!’ মান্নান মুখ তুলতে তিনি এবার ধীরে-ধীরে বললেন, ‘হ্যাঁ, এ ছেলে কাজের হবে, সৎ হবে।’ মান্নান সব সময় কথাটা মনে রাখে। কথাটা তাকে বাড়তি লোভের দিকে এগোতে দেয় না।

এত দিন ঢাকায় থেকেও থাকার জায়গা করে উঠতে পারেনি। অবশ্য এভাবেও বলা যেতে পারে, নেতারাই তাকে ছাড়েনি, সময়ে-অসময়ে হাতের কাছে কাজের সময় পেতে পার্টি অফিসের পেছনে ছোট একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ রুমেই তার কয়েক বছর কেটে গেছে, আরো হয়তো কিছুদিন কাটত যদি না হঠাৎ করে পথে তার যুদ্ধদিনের বন্ধু মামুনের সঙ্গে দেখা না হতো।

প্রায় জোর করে মান্নান তল্পিতল্পা সব গুটিয়ে তাকে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছে।

তুই এ কবছর ঢাকায় থেকেও আমার সঙ্গে দেখা করিসনি কেন রে?

দোস্ত, বিশ্বাস কর, সময় পাইনি, রাত-দিন পার্টির যত সব কাজ, বুঝলি না! সময়ই পাওয়া যায় না।

বুঝবো কচু! তুই এ কবছরে এত বড় গাধা হয়ে উঠেছিস, ভাবাই যায় না। শালা খেটেই মরছিস শুধু, কিছু পারমিট, লাইসেন্স বাগালেও বুঝতাম বন্ধুটি কাজের ছেলে।

মান্নান জিভ কাটে, ‘ছি-ছি, মামুন! ওকথা বলিস না।’

দূর শালা, আমি তোর সতীপনাকে নিকুচি করি। প্রাণ হাতে নিয়ে যুদ্ধ করলাম, ন’টা মাস কুকুরের মতো কষ্ট সহ্য করে শত্রু মেরেছি, কারা, আমরাই! আর আজ মজার মলাই রুটি খাচ্ছে কারা রে! তোর ওই গায়ে বাতাস লাগিয়ে ন’টি মাস কলকাতার শহরে ঘুরে বেড়ানো মন্ত্রীর দল! বড় বড় নেতার দল। আমি তাই সতী হয়ে থাকার ধার ধারি না! মামুুন হাত তুলে দেখাল, এই যে দেখছিস আমার গাড়ি। আগামী সপ্তায় দেখবি বদলে যাবে, সরকারি গাড়ি সব ইচ্ছেমতো নিজের কাছে রাখি, ইচ্ছেমতো চালাই। সরকার থেকে ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করি, আবার বেসরকারি টাকাও চুম্বকের আকর্ষণে ভয়ে-ভয়ে আমাদের কাছেই চলে আসে। তোর মতো শুধু ঘ্যান-ঘ্যান করে পার্টির কাজ করে মরি না, শুধু যখন আটকে যাই, সবকিছু বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপিয়ে দিলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করিÑ ‘বঙ্গবন্ধু যেখানে, আমরা আছি সেখানে!’ ব্যস্, দেখবি কেল্লাফতে!

মান্নান মামুনের দিকে তাকিয়ে থাকে, ওকে চেনা মুশকিল। কত পাল্টে গেছে। ও কেন এ রকম পাল্টে গেল। ও তো এ রকম ছিল না।

ওর সব বদলে গেছে, শুধু বদলেনি বন্ধুত্বের টান। সেই অকৃত্রিম টানের জোরেই মান্নানকে টেনে এনে তুলেছে নিজের বাড়িতে। যদিও মামুন এবং তার ফিরতে রাত হয়, তবু আরো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে-জেগে দুজন আড্ডা দেয়, যত জমে থাকা কথা, বলে শেষ হয় না।

পার্টি অফিস থেকে উড়ে এসে একেবারে মামুনের খাটের অর্ধেকটা জুড়ে বসায় তার বাবা ছাড়া বাড়ির কেউ তেমন পছন্দ করেনি। বিশেষ করে ওদের বাড়িতে উড়ে এসে জুড়ে বসা একদল মানুষ, যারা খায়-দায় আর বগল বাজায়। তারাই মান্নানের আসায় বেশি খাপ্পা।

মামুনের বাবা কন্ট্রাক্টর মানুষ, টাকা আসে চারদিক থেকে ঠিকই, কিন্তু খরচের দিকে অত হিসাব নেই। সেই সুযোগে আগাছার মতো বেড়ে গেছে লতায়-পাতায় দূরসম্পর্কের সব আত্মীয়। এই লতায়-পাতায় গজা মিঞাই সবচেয়ে বেশি ক্ষ্যাপা। প্রথম থেকেই বলে আসছে যখনই মান্নান তার মুখোমুখি হয়েছে, পার্টি-পুর্টি করে টাকা-পয়সা তো ভালোই কামান। আমাগো কিছু ধারধুর দিলে খুব উপকার হইতো আর কি।

বারবার চেয়ে এসব ধান্দাবাজ লোকেরা কিছু না পেলে সাংঘাতিক রেগে যায়। মান্নান ভাবল সে আমার কী-ই বা করবে। কিন্তু টুকটাকভাবে কাজ শুরু করে দিল গজা মিঞা। প্রথমেই যা ক’টা বই ছিল, উধাও করল। অতঃপর অন্দরমহলে তাকে লোফার টাইপের ছেলে হিসেবে প্রমাণিত করার চেষ্টা চালাল।

এসব ব্যাপারে মামুনকে কিছু বলার চেয়ে এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো ভেবে মান্নান চুপ রইল।

এভাবে ক্ষ্যাপানো গেল না দেখে গজা মিঞা অন্যপথ ধরল। পথে মান্নানের সঙ্গে দেখা হলে তার সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে চিৎকার করা শুরু করল, আওয়ামী লীগ নিপাত যাক, ভুট্টো আইস্যা চাল দিয়া গেছে বইলা হালারা বাইচা আছোস!

গজা ঠিকই জানে মান্নান এসব কথা শুনলে রেগে আগুন হয়ে যায়। মান্নান রেগে গেলেও চুপ করে মাথা নিচু করে হেঁটে যায়। এসব ইতর লোকদের সঙ্গে তর্ক করতে চায় না। ভাবে তার পার্টির ছেলেদের একটু বললেই ব্যাটাদের মুখ চিরতরে সেলাই করে দিয়ে যেত; কিন্তু আজ পর্যন্ত সে নিজের কোনো ব্যাপারে চারদিক তছনছ করা পার্টির রাগী ছেলেদের কোনো সাহায্য চায়নি, চাইবেও না।

তার অবাক লাগেÑ এই গজা মিঞাই স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে বুলেটের বাক্স মাথায় বয়ে ঘুরেছে। যতটা সাধ্য দৌড়ঝাঁপ করে সাহায্য করেছে। আজ তার মুখ দিয়ে এ রকম কথা কী করে বেরোয়। মান্নান নিজেকে সামলে নেয়, একটা ইঁদুরের মতো লোকের কথা শুনে এত উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়।

মান্নান টগবগে রাগকে চাপা দিয়ে ভাবে, সহসা অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সে ইচ্ছা করলেই মিরপুরে অবাঙালিদের ছোটখাটো সুন্দর একটা দোতলা বাড়ি দখল করে নিতে পারে। পার্টির অনেক ছেলেপুলেই তা করেছে।

আর তখনই তার কানে বেজে ওঠে বাতাসের মতো হু-হু করা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর, দেখি, ছেলেটির মুখটা দেখি। এ ছেলে কাজের হবে, এ ছেলে সৎ হবে।

তাদের দলের লোকজনের হাতে একটু ক্ষমতা আসতে না আসতেই তা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পাগল হয়ে ওঠে। সবাই যদি নিজের কথা না ভেবে দেশের এই দুরবস্থার কথা আগে ভাবত! এ ধরনের কথা মান্নান প্রায়ই পার্টির বড় নেতাদের বক্তৃতার কাগজে লেখে। কাগজে-কাগজে লেখা ছাড়া আর কী-ইবা করতে পারে। কিছু করতে পারুক আর না-ই পারুক, বঙ্গবন্ধুর নামে কেউ আজেবাজে কথা বললে প্রচ- রাগে তার শিরা-উপশিরা ঘুরে মাথায় উঠে যায়। রাগে কেঁপে ওঠে সে।

অশ্লীল কণ্ঠে আবার গজা মিঞা চেঁচিয়ে ওঠে, শেখ মুজিবেরে মাইরা দিছে, শেখ মুজিব মইরা গেছে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

মান্নানের ঘুমের ঘোর পুরোপুরি কেটে যায়। তড়াক করে খাট থেকে লাফিয়ে চেয়ারে বসে। তার শরীর কাঁপছে। নিজেকে আর সামলাতে পারে না। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। শুয়োরের বাচ্চাকে আজ বুঝিয়ে দিতে হবে, বেশি ত্যাঁদ্ড়ামোর ফল। ধরাম করে শব্দ করে দরজার কপাট খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মান্নান।

গজা মিঞা মান্নানকে দেখে ঘুরে দাঁড়ায়। আরো কাছে এগিয়ে আসে। তার হাতে ধরা ছোট্ট ট্রানজিস্টার চিঁ-চিঁ করে শব্দ ছড়াচ্ছে...

আমি মেজর ডালিম বলছি! আমরা খুনি শেখ মুজিবকে হত্যা করেছি...

মান্নানের মনে হলো দু-চার মুহূর্তে শরীরের সব উত্তাপ থেমে গেছে। তারপর সারা শরীরে যেন কনকনে শীতে কেঁপে উঠল। প্রচ- ঝড়ে যেমন জাহাজের লক্ষ্য পাল্টে যায়, তেমনি গজার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে সে দৌড়ে বাইরে চলে এলো।

রাতে মান্নান প্যান্ট পরেই ঘুমায়, পায়ে শুধু স্যান্ডেল নেই। ধুপখোলা মাঠের ধারঘেঁষে ছুটতে ছুটতে কুলুটোলার পুলের কাছে এসে থামল। সারা পথে লোকজন সন্ত্রস্তভাবে এদিক-ওদিক করছে। পুল পেরিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে লক্ষ্মীবাজার পার্টি অফিসে ঢুকল সে। ইতোমধ্যে কেউ তালা ভেঙেছে, দরজা হাঁ করে বাতাস গিলছে। ভেতরে লোকজন নেই, টেবিল-চেয়ার সব ঠিকঠাক জায়গামতো আছে। দেয়ালের ফ্রেমে বাঁধানো বঙ্গবন্ধু হাসছেন।

মান্নান মাথা তুলে তাকিয়ে থাকল। ধীরে ধীরে চোখ তার ভিজে উঠতে দেখলÑ ছবির ফ্রেমের পাশে টাঙানো বিরাট দেয়াল ঘড়িটা ইতোমধ্যে কেউ নিয়ে গেছে।

দ্রুত পায়ে সে আবার পথে নেমে এলো। নয়াবাজার, নবাবপুর সব পার্টি অফিসের একই অবস্থা। বড় রাস্তার চেয়ে গলিগুলোতে বেশি কোলাহল। ফুলবাড়িয়া পেরিয়ে গুলিস্তানের দিকে এগিয়ে আসে, রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দূরে স্টেডিয়ামের মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কালো ট্যাংক।

ট্যাংকের পিঠ ফুঁড়ে বুক পর্যন্ত বেরিয়ে আছে কালো পোশাকের দুজন সেনা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের বড় বড় বিল্ডিংয়ের মাঝে-মধ্যে সরু গলি থেকে ইঁদুরের মতো মাথা বাড়িয়ে দেখছে কিছু লোক।

মান্নান বড় বড় বিল্ডিংয়ের ছায়াঘেঁষে ধীরে ধীরে এগোয়। কোনোভাবে কাকরাইল পর্যন্ত যেতে পারলে হয়। পার্টির এক বড় নেতার বাড়ির কাছে পৌঁছানো যাবে। আরেক বড় নেতার বাড়ি সেই জিগাতলার কাছে, ধানমন্ডি। অতটা পথ যাওয়া যাবে কি না কে জানে?

নেতারা সম্ভবত এতক্ষণে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। মান্নানের শরীরের ভেতর কেউ যেন ঝাঁকাচ্ছে, খুব দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। নেতারা উদ্যোগ নিলে লাখ লাখ জনতা আজ তছনছ করে দেবে মুখোশধারী খুনিদের। উত্তেজনায় তার সাহস অনেক বেড়ে গেছে, ধীর পায়ে ট্যাংকের পাশ কাটিয়ে সে পুরানা পল্টনে ঢুকে পড়ল। পল্টনের গলির ভেতরে ভেতরে ঘুরে পৌঁছে গেল কাকরাইল।

নেতার বাড়ির গেটে বিরাট তালা। তবে ভেতর থেকে খুব মৃদু চাপা গুঞ্জনের রেশ ভেসে আসছে। মান্নান দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকতেই চাপা হই-হুল্লোড় পড়ে গেল। দড়াম-দুড়–ম করে বাড়ির দরজা-জানালা দু-একটা, যা খোলা ছিল বন্ধ হয়ে গেল।

মান্নান বারান্দা পেরিয়ে বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে নেতাকে ডাকতে লাগল। পরিচিত গলা শুনে নেতার গিন্নি হুক নামিয়ে দরজার কপাট ফাঁক করলেন। মান্নান প্রায় তাকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। নেতা বিছানায় শুয়ে আছেন, মাথাটা খাট থেকে বের করা। মাথার ঠিক নিচে বালতি। কিছুক্ষণ আগেও তার মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। ভেজা মাথা, চোখ বোজা।

নেতার গিন্নি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, বুঝলে মান্নান, খবরটা পেয়েই তিনি ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হন-হন অবস্থা। মুখে ফেনা আর চোখ গোল্লা পাকিয়ে উঠেছিল। এ রকম অবস্থায় শরীর-টরির বেশি খারাপ হলে কোথায় ডাক্তার পাব! বলো তো, আমরা এখন কী করব?

মান্নানের এ রকম পরিবেশে দেখে খুব অস্থির লাগছিল। হুট করে বলে বসল, আমিও নেতার কাছে জানতে এসেছি, এখন আমরা কী করব? নেতা পিট-পিট করে চোখ খুললেন, বেশ জোরে ডেকে উঠলেন, কে? কে? ওহ্, তুমি? তুমি আবার কোত্থেকে হাজির হলে এ দুঃসময়ে! আমার বোধহয় এ বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না। তুমি কী মনে করো, মান্নান? ওই, ওই যে তোমার ভাবিকে এক ঘণ্টা ধরে বলছি, তার বড় ভাইকে ফোন করতে। গোপনে যেন গাড়ি নিয়ে এসে আমাকে নিয়ে যায়।

মান্নান কিছু বলার আগেই নেতা উঠে বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। মান্নানের ইচ্ছে করছে পা দিয়ে ঘষে সারা বাড়ির পাকা মেঝে খুঁড়ে ফেলে। লাথি মেরে দেয়াল ভেঙে চুরমার করে। সময় যত গড়াচ্ছে ততই অধৈর্য হয়ে উঠেছিল সে।

নেতা খেঁকিয়ে উঠলেন, আগে বাছাধন জান বাঁচাও! বেঁচে থাকলে প্রতিশোধ নেওয়ার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আর তোমার ভয়ইবা কী! তুমি তো আর হাতেগোনা ‘ফিগার’ নও, আমাদের কিন্তু ওরা ছাড়বে না। জানো তো, যাদের পেয়েছে সবাইকে মেরেছে। যাদের পাবে, তাদেরও মারবে। এই ‘যাদের’ হচ্ছি আমরা, তোমরা নও।

মান্নান বুঝল নেতা পালাতে চান, আপাতত নিজেকে লুকোতে চান।

নেতার গিন্নি এমন মুখ করে আছেন, যেন নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না মান্নান না যাওয়া পর্যন্ত।

সে আবার রাস্তায় বেরিয়ে এলো। ফাঁকে-ফাঁকে, লুকিয়ে কখনো কালো পোশাক পরা সেনাদের চোখের সামনে ঘুরপাক খেয়ে, মগবাজার-কাঁঠালবাগান হয়ে জিগাতলা আরেক নেতার বাড়িতে চলে এলো।

সারা বাড়ি ফাঁকা। দরজায় বড়-বড় তালা ঝুলছে। এখন নেতাদের পাওয়া মুশকিল।

আবার রাস্তায় নেমে সে ভাবতে লাগল, ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে সহজে কীভাবে যাওয়া যায়। ঠিক সূর্য যখন মাথার ওপর, তখনি মান্নান বত্রিশ নম্বরের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বহুদূরে ছড়ানো-ছিটানো কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে ওবাড়ির দিকে তাকিয়ে। গাছগাছালি ঘেরা বাড়িটা যেমন ছিল, তেমনি দেখাচ্ছে। বাড়ির বড় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্যাংক আর বেশ কিছু সৈন্য। ট্যাংকের লম্বা নল ঘুরছে চারদিকে। মান্নান আড়ালে এদিক-ওদিক করে বাড়িটার একেবারে কাছে গেলে গোফওয়ালা একজন শার্টের কলার চেপে মাটি থেকে শূন্যে তুলে আছড়ে ফেলল। আবার তুলে নিল। গলায় শার্ট ফাঁসের মতো আটকে যাওয়ায় মান্নানের চোখ মাছের মতো বেরিয়ে আসতে চাইল।

তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসা দেখে কিংবা শুঁটকো শরীর, করুণ মুখ দেখে, যেকোনো কারণেই হোকÑ পাছায় কষে একটা লাথি ঝেড়ে ভাগিয়ে দিল তাকে।

মান্নান দ্রুত কিছুদূরে সরে গেল, বিশাল ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শ্বাস টেনে নিল। ঠোঁটে দাঁত চেপে বসায় কেটে গেছে, সারা মুখে সল্টেড বিস্কুটের স্বাদ। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবল মান্নান, করার এখন কী-ইবা আছে, কী সে করতে পারে? ভাবতে-ভাবতে হন-হন করে রাগের মাথায় হাঁটতে লাগল। রাগে অন্ধের মতো দীর্ঘ মিরপুর রোড, এলিফেন্ট রোড পেরিয়ে শাহবাগের চৌরাস্তায় এসে পড়ল। চৌমাথায় দাঁড়িয়ে আছে ট্যাংক। আরেকটি বেতার অফিসের সামনে। রেডিও এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে।

মান্নান এদিক-ওদিক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। নিজেকে খুব অসহায় একা লাগছে, একা একজন কী করতে পারে! হাজার-হাজার, লাখ-লাখ মানুষ কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে হয় জনতা, শক্তি। একা সে কী করবে? একাকিত্বে, অসহায়ত্বে নিজেই রেগে উঠেছে। আর তখনি তার তীব্র ইচ্ছেগুলো স্বপ্নের মতো উড়ে-উড়ে চোখে এসে বসতে লাগল।... এলিফেন্ট রোড দিয়ে বিরাট মিছিল এগিয়ে আসছে হাজার-হাজার জনতার। নীলক্ষেত-বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে আসছে দুর্বার ছাত্রলীগের মিছিল। বায়তুল মোকাররম, পল্টন ঘুরে হুঙ্কার ছেড়ে এগিয়ে আসছে শ্রমিক লীগ আর অগণিত শ্রমিকের মিছিল। সেøাগানের হুঙ্কারে কেঁপে উঠছে রাস্তা, পাশের প্রত্যেক বাড়ির জানালার কাচ, গাছগাছালির প্রতিটি পাতা কাঁপছে। মানুষের প্লাবন খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নল উঁচানো হাতে ছড়ি তুলে জনতাকে ভয় দেখানো ট্যাংক, ভূতের মতো কালো পোশাকের সৈন্যদের। কোনো কিছু প্লাবনের স্রোতে দাঁড়াতে পারছে না।

হঠাৎ ঢং..ঢং..ঢং লাইট পোস্টে রড পেটানো শব্দে মান্নানের ইচ্ছেস্বপ্ন ভেঙে গেল।

রমনা পার্কের পাশে উলঙ্গ এক পাগলি তলপেটের নিচটুকু বারবার লাইট পোস্টে ঘঁষছে আর ঢং-ঢং রড পিটিয়ে চিৎকার করছে, দেশে একটা বেটা নাই! একটা বেটা মানুষ নাই! সব চিকা!* সব চিকা! আয় কোন্ বাপের বেটা আছে। আয়, আমার কাছে আয়।

মান্নান দ্বিতীয়বার আর ওদিকে তাকাতে পারল না। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল সবুজ পার্কে। লতায়-পাতায় ঢাকা প্রায় অন্ধকার হয়ে থাকা একটা বেঞ্চে পা তুলে চিত হয়ে শুয়ে কান খাড়া করে বারবার শুনতে লাগল লাইট পোস্টের রড পেটানোর শব্দ ঢং... ঢং... ঢং...।

* ঢাকার কথ্য ভাষায় ‘চিকা’ মানে হিজড়া বা নপুংসক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close