জোবায়ের মিলন
প্রতিদিনের সংবাদের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তরুণদের ভাবনা
নীল সময়ে সাদা দূত
সময়ের নীল সাগর পাড়ি দিচ্ছি আমরা। আমাদের পায়ের নিচে মাটি নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই, ডানে রাক্ষস, বামে নেকড়ে। অস্থির মানসিকতা ভর করে আছে আমাদের চারপাশে। অদ্ভুত এক নকশার ভেতর দিয়ে সাপের শরীরের মতো, জিলেপির প্যাঁচের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক দিন। আপাতদৃষ্টিতে জলের ওপর তলে কোথাও কোনো ছেদ নেই। কোথাও কোনো বিচ্ছেদ নেই। দৃষ্টির অতলে গভীর খাদ তৈরি হয়ে আছে প্রত্যেকের ভাগ্যলিলায়। সেখানে প্রত্যেকে নিঃশ্বাস ভারী করে শ্বাস নিচ্ছি আর ফেলছি। চলার পথে পাশের কাউকে দেখলেই মুখে হাসিহাসি ভাব করে মৃদু হাসিতে জানান দেওয়ার চেষ্টা করছিÑআমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন? বিপরীত দিকেও একই চিত্র, একই অভিনয়Ñ আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন? ভালো আছি। আসলে ভালো আছি কি? রাজমহলের রাজা থেকে প্রজামহলের প্রজাÑকে ভালো আছে? কে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তজীবন অতিবাহিত করছে? কার কোনো দুর্ভাবনা নেই? কার নিদ্রায় অজগর ঢোকে না? কে আপামর জীবনের কথা, স্বপ্নের কথা ভেবে আঁতকে ওঠে না? কে বুকের ছাতিম উঁচু করে বলতে পারে, সে পূর্ণ সুখী? বঙ্গরাষ্ট্রের প্রধান কর্তা থেকে অপ্রধান কর্ম পর্যন্ত কে আছেন যে তার দিনলিপি নিয়ে শতভাগে আনন্দিত? একি শুধু বঙ্গরাষ্ট্রে! বিশ্বময়তায় আজ যে অনল জ্বলছে, তার নাম কে জানে। কী নামে তাকে ডাকা যায়। কোন চিত্রে তাকে অবহিত করা যায়, তা কারোরই জানা নেই। উত্তর গোলার্ধ্ব থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ্বে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা কাউকে বর্ণনা করতে হয় না, সবাই জেনে যায়। সবাই দেখতে পায়। দেখতে পাচ্ছে। একদিকে প্রাণের পতন আরেক দিকে জীবনের জয়গানে মুখরতা। কী অদ্ভুত দ্বৈতনীতি উড়ে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে অগ্নিগোলকের মতো। সবাই দেখতে পাচ্ছি, সবাই বুঝতে পারছি, সবাই সবার নিজের স্বার্থে মুখে মুখোশ এঁটে নীরব দর্শকের সুশীল ভূমিকা পালন করছি। সত্য উচ্চারণ করছি না, যদি পাছে কোনো ক্ষতি নয়, লাভের পাল্লা ফসকে যায়!
লাভ আর ক্ষতির সঙ্গে যারা মধ্যস্থতা করে না। যারা আগুনকে আগুন বলে, যারা পানিকে পানি বলে, যারা অসত্যের সঙ্গে সহজ শর্তে মীমাংসা করে না, তারা আজকের বৈরী দিনেও সুন্দর। সংবাদপত্র সৌন্দর্যের মালী। নিত্য সুন্দরকে সংবাদপত্র বিকশিতের পথ দেখায়, রূপ দেখায়, কল্পনা করতে শেখায়। সংবাদপত্র ছোট্ট মুঠোর ভেতর ধারণ করে বিরাট পৃথিবীকে। সে পৃথিবীর রশ্মি যারা দেখতে চায়, তারা বিজ্ঞ হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। তারা পৃথিবীকে আত্মস্থ করে ক্রমান্বয়ে। একদিন পৃথিবীর মতো তারাও হয়ে ওঠে চেতনের রশ্মিতে ভারী। সংবাদপত্র মানুষকে শুধু সারা দুনিয়ার সংবাদ জোগাড় করে চোখের সামনে মেলেই ধরে না। সংবাদপত্র সচেতন মহলের সামনে একটি বিদ্যালয় হয়ে প্রস্ফুটিত হয়। যেখানে প্রতিদিন জানার সঙ্গে সঙ্গে শেখারও মুদ্রা থাকে সহস্র। একদা সংবাদপত্রে সামান্য সংবাদ প্রকাশ হলেও আজকের সংবাদপত্রে কেবল সংবাদ প্রকাশ পায় না; একজন মানুষের প্রয়োজনীয় সব বিষয়ই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় জানার, শোনার বিষয় থেকে আনন্দ-বিনোদনের পঞ্চমাত্রা, প্রকাশিত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের জানা-অজানা হাজার তথ্য, প্রকাশিত হয় ভূত-ভবিষ্যতের নানা মাত্রিক উপাত্ত; যেখানে বাদ যায় না দেহ-মনের দশদিকও। জানা যায়, পাঠ্যপুস্তকের কঠিন প্রশ্নের উত্তর থেকে জটিল গণিতের সমাধান পর্যন্ত। জানা যায়, শূন্য থেকে মহাশূন্যের রহস্য। জাগতিক এমন কিছু নেই, যা আজকের সংবাদপত্রে মেলে না।
অত্যাধুনিক যুগে এসে প্রশ্ন উঠেছে, কাগজের সংবাদপত্র টিকবে কিনা? পাতায় লেখা কালো অক্ষর আর পড়বে কিনা মানুষ। ই-সময়ে মানুষ ইলেকট্রনিকস ডিভাইস রেখে পাতা হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরবে কিনা? প্রশ্ন যতই উঠুক, কালো অক্ষরের স্বাদ যার মগজে লেগেছে, তাকে আর কোনো ডিভাইসই বিচ্যুত করতে পারবে না। অত্যাধুনিক এ সময়ে ই-দৈনিক হাতের কাছে সহজলভ্য হলেও প্রিন্ট সংস্করণ মরে যায়নি, সামনের সহস্র বছরে মরবে বলেও ঈঙ্গিত পাওয়া যায় না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রের রূপে রঙে যে পরিবর্তন, যে গঠন গড়নের পরিবর্তন হচ্ছে তাতে বরং সংবাদপত্রের চাহিদা ও পত্রপাঠের আগ্রহ বাড়ছে বলেই মনে হয়। আপাতদৃষ্টিতে বা কারো কারো মতে দৈনিক সংবাদপত্রের চাহিদা নিচের দিকে হলেও সে নিচের দিকের কারণ ভিন্ন ও বহু উপাত্তের মিশ্রণ, সংবাদপত্রের প্রতি অনীহা নয়। বরং এ বলা যায়, এই স্যাটেলাইট যুগেও সংবাদপত্রের পাঠক বাড়ছে সংবাদের গুণগত মান ও বহুমাত্রিকতার কারণে। সময় যখন নানা অলিগলি পথ ধরে লাল-নীল-বেগুনী বাঁক পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, নাজুক সুস্থতায় তখন সংবাদ ও সংবাদপত্রের সত্য, চ্যালেঞ্জ ও নিষ্ঠতার কারণে মানুষ সংবাদের জন্য সব মাধ্যমের চেয়ে সংবাদপত্রের ওপরই নির্ভর করছে বেশি। বিশ্বাস করছে অধিক। টেলিভিশন, রেডিও বা অন্য মাধ্যমের সংবাদ এক শ্রেণির আর সংবাদপত্রের সংবাদ সব শ্রেণির। আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই দৈনিক পত্রিকা পাঠ করে। একজন শিশুর জন্যও এখনকার দৈনিকগুলোতে নানা রকম সংবাদ, কার্টুন, ছড়া, কবিতা, গল্প, চিত্রের সংযোগ করে থাকে, যা অন্য মাধ্যমে সহজ নয়। তবে সংবাদপত্র থাকবে কি থাকবে নাÑএমন প্রশ্ন আর চ্যালেঞ্জের সময়ে একটি সংবাদপত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ বা তথ্য প্রকাশ ও প্রচার। এ ক্ষেত্রে ‘প্রতিদিনের সংবাদ’ এক বিরাট চ্যালেঞ্জেরে নাম। প্রায় প্রথম থেকে দৈনিকটির পাশাপাশি থেকে নিরীক্ষা দৃষ্টিতে আজকে এসে নির্দ্বিধায় বলতেই পারছি, সততা, সত্যতা শ্রম আর একাগ্রতায় মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে থাকতে দৈনিকটি অগ্রসর বৈ পিছপা হয়নি। সপ্তাহের সাতটি দিনের সঙ্গে সারা বছর ধরে বিশেষ আয়োজনে মানুষের কাছে যেতে চেয়েছে যোগ্যতায়, কতটা পেরেছে তা পাঠকমাত্রই জানেন। আমি তাকে পেয়েছি বন্ধুর মতো সাহায্যের হাত হিসেবে। তাকে কখনো দেখিনি অসত্য, মিথ্যা, উগ্রতা, হলুদ সংবাদ পুঁজি করে দিনকে পাড়ি দিয়ে দিনান্তে পৌঁছাতে। একটি দিনকে সারবত্তা না ভেবে আগামীর কথা মাথায় রেখে শান্তি, সম্প্রীতি ও ঐতিহ্যের অঙ্গীকারে যেন ‘প্রতিদিনের সংবাদ’-এর যাত্রা।
সুন্দরের শেষ নেই, সৌন্দর্যের বিনাশ নেই। প্রতিযোগিতার বাজারে আজ থেকে আগামীর পথে একই ধারা বজায় রেখে আরো আরো সুন্দরের পথে ‘প্রতিদিনের সংবাদ’ ধাবিত হবে- নম্রতায় সুষ্ঠুতায়; এ রূপটি ‘প্রতিদিনের সংবাদ’-এর প্রতি প্রত্যাশা করছি/করতেই পারি একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে। মঙ্গল হোক ‘প্রতিদিনের সংবাদ’-এর।
"