আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

বাবার হাত ধরেই উত্থান বাশারের, দুই যুগ পর পতন

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় ২০১১ সাল থেকে চলছে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। ১৩ বছর পরও লড়াই-রক্তপাত থামেনি। এরইমধ্যে গতকাল পতন ঘটল প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের। বিদ্রোহীদের একের পর এক শহর দখলের জেরে রাজধানী দামেস্ক ছেড়ে অজানায় চলে গেছেন তিনি। রাজধানী দখলে নিয়েছে বিদ্রোহী এইচটিএস গোষ্ঠী। বাবা হাফিজ আল-আসাদের হাত ধরে উত্থান ঘটেছিল বাশারের। অবশেষে দুই যুগ পর ঘটল পতন।

১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন হাফিজ আল-আসাদ। ২০০০ সালে তার মৃত্যু হয়। ওই বছরই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তার ছেলে বাশার আল-আসাদ। ২৪ বছরের মাথায় এসে ক্ষমতাচ্যুত হলেন আসাদ। সম্প্রতি সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের (আলেপ্পো ও হামা) নিয়ন্ত্রণ নেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা। এরপর হোমসসহ অন্যান্য শহরের নিয়ন্ত্রণ নেন তারা। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্বে থাকা হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করা তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট আসাদ উড়োজাহাজে করে রাজধানী দামেস্ক ছেড়েছেন বলে রোববার জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। তবে তিনি কোথায় গেছেন, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

হাফিজ আল-আসাদকে ‘আধুনিক সিরিয়া’র রূপকার বলা হয়। ১৯৩০ সালে সিরিয়ায় তাঁর জন্ম। ছিলেন আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টির নেতা। ১৯৪৬ সালে দলটির রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। ১৯৫৫ সালে হাফিজ বিমানবাহিনীর পাইলট হিসেবে যোগ দেন।

সিরিয়ায় বাথ পার্টিকে শক্তিশালী করতে হাফিজের ভূমিকা ছিল। ১৯৬৬ সালে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন হাফিজ। রাজনৈতিকভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে নিজ রাজনৈতিক গুরু ও সিরীয় নেতা সালাহ আল-জাদিদকে সরাতে অভ্যুত্থান ঘটান হাফিজ। পরের বছরই সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন তিনি।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বরাবর ‘খেলুড়ে’ নেতা ছিলেন হাফিজ আল-আসাদ। ১৯৭৩ সালে মিসর-ইসরায়েল যুদ্ধে তিনি মুসলিম মিত্র কায়রোর পক্ষে অবস্থান নেন। প্রায় দুই দশক পর ১৯৯১ সালে তিনিই আবার ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। ইসরায়েলের দখলে থাকা গোলান মালভূমি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় ভূমিকা রাখেন।

ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনকে ‘দীর্ঘদিনের শত্রু’ মনে করতেন হাফিজ। ১৯৯০-৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সিরিয়া বাগদাদের বিপক্ষে ছিল। তিনি এ যুদ্ধে পশ্চিমা জোটকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

টানা ২৯ বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০০ সালের ১০ জুন দামেস্কে মারা যান হাফিজ। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের শাসনের সূচনা হয়। ওই বছরের ১৭ জুলাই প্রেসিডেন্ট পদে বসেন তার ছেলে বাশার আল-আসাদ।

টানা ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। উদ্বাস্তু হয়েছেন দেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ। ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ মানবিক সংকট শুরু হয় সিরিয়ায়। এত কিছুর পরও আসাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না; বরং নিজের কর্তৃত্ব আরও পাকাপোক্ত করেন।

২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে-পরে একজন সাংবাদিক বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্ট বাশারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি এএফপিকে বলেন, ‘বাশার একজন ব্যতিক্রমী ও জটিল চরিত্রের মানুষ।’

নিজের নাম গোপন রাখার শর্তে বাশারের সঙ্গে দেখা করার অভিজ্ঞতা জানিয়ে ওই সাংবাদিক বলেন, ‘প্রতিবারই তাকে বেশ শান্ত দেখেছি। এমনকি যুদ্ধের চরম উত্তেজনার সময়ও বেশ শান্ত থাকেন। বাবার কাছ থেকে এ গুণ পেয়েছেন তিনি।’

হাফিজ আল-আসাদের উত্তরসূরি হওয়ার কথা ছিল না তার ছোট ছেলে বাশার আল-আসাদের। প্রথা মেনে হাফিজের পর তাঁর বড় ছেলে বাসেল আল-আসাদ ক্ষমতার কেন্দ্রে আসবেন, এটাই ভেবেছিলেন অনেকে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় বাসেলের মৃত্যু হয়। এতে সিরিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যায়।

বাবার উত্তরসূরি হিসেবে দৃশ্যপটে আসেন বাশার আল-আসাদ। তখন বাশার লন্ডনে চক্ষুবিজ্ঞানে উচ্চতর পড়াশোনা করছিলেন। বাবার নির্দেশে দেশে ফেরেন। এরপর সিরিয়ায় সামরিক বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। রাজনৈতিক বিষয়ে হাতে-কলমে জ্ঞানার্জন করতে থাকেন।

কাজেই বলা যায়, বাশারকে তার বাবাই একজন শাসক হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। ২০০০ সালে বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি দেশের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেন। ২০০৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাশার পুনর্র্নিবাচিত হন।

শাসনামলের শুরুর দিকে বাশার সংস্কারের ভূমিকা রাখেন। প্রশাসনিক-রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে হাটেন। এ ক্ষেত্রে বাবার আমলের বেশ কিছু কঠোর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেন তিনি। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরোধী তিনি।

প্রেসিডেন্ট হয়েও শুরুর দিকে আসাদকে সাধারণ জীবন কাটাতে দেখা যেত। গাড়ি চালাতেন নিজেই। ব্রিটিশ-সিরীয় স্ত্রী আসমাকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোরাঁয় নৈশভোজে যেতেন। ওই সময় তরুণ, পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও আধুনিক মানসিকতার বাশার সিরীয়দের কাছে পছন্দের মানুষ ছিলেন।

তবে পরিস্থিতি ক্রমেই বদলে যায়। সংস্কারকের ভূমিকা থেকে আসাদ কর্তৃত্ববাদী শাসক হয়ে উঠতে শুরু করেন। বিরোধী মত দমনে তার কুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। সিরিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয় অনেক সরকারবিরোধী শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীকে। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা গণতন্ত্র সিরিয়ার জন্য নয়।’

বাশার ক্ষমতা নেওয়ার আগে থেকেই সিরিয়ার তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও বাক্?স্বাধীনতার অভাববোধ থেকে তুমুল হতাশা ছিল, যা উসকে দেয় আরব বসন্ত।

২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার দক্ষিণের শহর দেরাতে প্রথম সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে এর আগে দেশটির বিভিন্ন স্থানে ছোট ও বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভ দমাতে সরকারি বাহিনীকে মাঠে নামান বাশার। দমনপীড়নের মুখে বিক্ষোভকারীরা বাশারের পদত্যাগের দাবি তোলেন। এতে বেড়ে যায় দমনপীড়ন। সেই সঙ্গে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিরিয়ায়। একপর্যায়ে বাশারবিরোধীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেন। তাদের ‘বিদেশি শক্তির মদদে পরিচালিত সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাশার সরকার। সিরিয়াজুড়ে শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী বাশারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। একের পর এক এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দেশটিতে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। টানা ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। উদ্বাস্তু হয়েছে দেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ। ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ মানবিক সংকট শুরু হয় সিরিয়ায়। এত কিছুর পরও আসাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ হয়নি।

দীর্ঘ এ লড়াইয়ে আসাদের পাশে ছিল মিত্র ইরান ও রাশিয়া। লেবাননের হিজবুল্লাহও আসাদের বেশ ঘনিষ্ঠ। এতে পশ্চিমা শক্তিগুলোর ঘোর আপত্তি। বেসামরিক মানুষের নির্বিচার মৃত্যু, ২০১৪ সালের সাজানো নির্বাচন, বেসামরিক মানুষের ওপর রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে তুমুল বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়ে আছেন বাশার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close