প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ০৪ জুলাই, ২০২২

ভারতে আবার বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কৃষকরা

আন্দোলন নিয়ে বৈঠকের প্রস্তুতি

ভারতে ২০২০ সালে কৃষি আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যের লাখ লাখ কৃষক বিক্ষোভে জড়ো হয়েছিলেন দিল্লির উপকণ্ঠে। বিক্ষোভকারীরা এক বছরের বেশি সময় ধরে দিল্লির উপকণ্ঠে হুংকার তুলেছিলেন। তীব্র দাবদাহ, কনকনে শীত এমনকি করোনার ভয়াবহতার মতো প্রতিকূলতার মধ্যেই সেখানে বছরব্যাপী অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন ক্ষুব্ধ কৃষকরা। বাধ্য হয়ে সরকার কৃষকদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সরকারের ওই ঘোষণার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কৃষকরা মনে করছেন, তাদের দাবি পূরণ হয়নি। এখন করণীয় ঠিক করতে বৈঠক ডেকেছেন বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেওয়া কৃষক নেতারা। বৈঠকে রাকেশ টিকায়েতের মতো কৃষক নেতারাও থাকবেন। আবার আন্দোলন শুরু করার সম্ভাবনা নাকচ করে দিচ্ছেন না কৃষকরা। খবর বিবিসির।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়াদের একজন ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের নারী কৃষক বাচিত্তার কৌর। তিনি বলেন, ‘আমি তখন আমার বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের বলেছিলাম, আমি বিক্ষোভ করতে করতে মরে যাব কিন্তু কৃষি আইন কার্যকর করতে দেব না।’

অবসরপ্রাপ্ত এ স্কুলশিক্ষক বলেন, আরামের সংসার ছেড়ে রাস্তায় ট্রাক্টরের ট্রলিতে রাতের পর রাত কাটানোর ব্যাপারটা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ এসব কৃষি আইন ছিল আমাদের জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা।

বিক্ষোভ শুরুর পর দীর্ঘ সময় সরকার বারবার জোর দিয়ে বলে আসছিল, কৃষকদের ভালোর জন্যই আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে এবং এখান থেকে পিছিয়ে আসার কোনো প্রশ্নই আসে না। সরকারি প্রতিনিধি ও কৃষক নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করেও এ অচলাবস্থা নিরসনে ব্যর্থ হন। বিক্ষোভরত কয়েকজন কৃষকের মৃত্যু হয়। এদিকে বিক্ষোভ ঠেকাতে দমনাভিযান ও ধরপাকড় শুরু করে সরকার। এ সময় বহু কৃষক গ্রেপ্তার হন। কিন্তু ১৯ নভেম্বর এসে ঘটনার বাঁকবদল হয়। ইউটার্ন নেয় সরকার। সেদিন সরকার একগুঁয়ে অবস্থান থেকে সরে এসে কৃষি আইন (সংশোধিত) প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপর কৃষি আইন (সংশোধনী) বাতিলের জন্য তোলা একটি বিল ৩০ নভেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস হয়।

তবে সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তা ছাড়েননি বিক্ষোভরত কৃষকরা। এবার তারা বলেন, সরকার তাদের দাবি না মেনে নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তারা। তাদের দাবির মধ্যে ন্যূনতম ফসলের দাম বেঁধে দেওয়ার নিশ্চয়তার বিষয়টিও ছিল।

কয়েক দিন পর সরকার সেই দাবিও মেনে নেয়। এর মধ্য দিয়ে বছরব্যাপী দীর্ঘ কৃষক বিক্ষোভ বন্ধ হয়। বাচিত্তার কৌর বলেন, সেটি ছিল তার জন্য বিশেষ একটি মুহূর্ত।

কিন্তু কৃষকরা ঘরে ফেরার সাত মাস পার হয়ে গেলেও সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের দাবি পূরণ করেনি। এখন করণীয় ঠিক করতে গতকাল রবিবার বৈঠকে বসার কথা বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেওয়া কৃষক নেতারা।

বাচিত্তার কৌর বলছেন, ‘আমরা সময় ও স্থান নির্ধারণে নেতাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। ভবিষ্যতে যা-ই হোক না কেন, তার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের।’

বিক্ষোভের শুরু ২০২০ সালের নভেম্বরে। ফসল বিক্রির নিয়ম শিথিল, ফসলের দাম, ফসলের মজুদ নিয়ে সরকার তিনটি আইন প্রণয়নের পরই লাখো কৃষক রাজধানী দিল্লি অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। দশকের পর দশক ধরে ফসলের ন্যায্যমূল্য পেতে যে আইন ছিল, তাতে সংশোধনী আনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা।

বিক্ষোভকারীদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগে ছিল নতুন এসব আইনে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল সরাসরি কৃষি ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সুপার মার্কেট চেইন ও অনলাইন দোকানদারের কাছে বিক্রির পথ তৈরি হবে। কিন্তু বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, ভারতের বেশির ভাগ কৃষক সরকারনিয়ন্ত্রিত পাইকারি বাজারে অথবা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে (যা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি হিসেবেও পরিচিত) তাদের ফসল বিক্রি করেন।

সরকারের দাবি, এসব আইনের কারণে বেশি দামে ফসল বিক্রি করতে পারবেন কৃষকরা। কিন্তু সরকারের এ দাবির সঙ্গে একমত নন কৃষকরা। তারা বলছেন, নতুন এসব আইনের কারণে ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে বড় কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়বেন তারা। তখন এসব প্রতিষ্ঠানই ফসলের দাম ঠিক করে দেবে।

অবশেষে সরকার যখন ঘোষণা দেয় তারা এসব আইন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, তখন এ নিয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কমিটিতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিপণ্য, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কৃষক নেতাদেরও রাখার কথা বলা হয়। তারাই আলোচনা করে এমএসপির বিষয়টি দেখবেন। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং দুই মাস আগে ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, সরকার প্যানেল গঠনের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক সূত্র বলছে, এটা এখনো হয়নি। প্যানেলে কৃষকদের প্রতিনিধি হিসেবে কারা থাকবেন, তাদের তালিকা কৃষক নেতাদের কাছে চেয়েছে সরকার। কিন্তু কৃষকরা নাম পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান তারা। কৃষক নেতারা বলেন, সরকারের মতলব কী, সেটা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।

এমএসপি ছাড়াও কৃষকনেতাদের আরো কিছু দাবি আছে। এর মধ্যে বিক্ষোভের সময় যেসব কৃষকের মৃত্যু হয়েছে, তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও বিক্ষোভ করায় যেসব কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেসব মামলা প্রত্যাহার করা।

পাঞ্জাবে কৃষকদের অন্যতম বৃহৎ সংগঠন ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের (বিকেইউ) প্রেসিডেন্ট জোগিন্দর সিং উরাহান বলছেন, ‘কিছু ফসলের ক্ষেত্রে এমএসপির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে এটা সব রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না, সেটাই এখনো দেখার বিষয়। কারণ সরকার বিষয়টি তাদের কাছে স্পষ্ট করেনি। বৈঠকে বসার আগে তাদের (সরকার) আমাদের বলতে হবে বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হবে এবং এমএসপি সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণে তাদের (সরকারের) পরিকল্পনা কী?’

এমএসপি ছাড়াও কৃষক নেতাদের আরো কিছু দাবি আছে। এর মধ্যে বিক্ষোভের সময় যেসব কৃষকের মৃত্যু হয়েছে, তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, ধানের নাড়া পোড়ানোয় কৃষকদের বিরুদ্ধে আনা অপরাধের তদন্তে কার্যক্রম বাতিল ও বিক্ষোভ করায় যেসব কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেসব মামলা প্রত্যাহার করা।

জোগিন্দর সিং উরাহান বলছেন, কৃষি আইন বাতিলের সময় গত নভেম্বরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব কৃষক ইউনিয়নের জোট সংযুক্ত কিষান মোর্চাকে (এসকেএম) লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, কৃষকদের এসব দাবি মেনে নেওয়া হবে। তিনি বলেন, কিছু শর্ত মেনে নেওয়া হলেও (কিছু রাজ্যে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে) বিক্ষোভরত কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টির সুরাহা হয়নি।

বিক্ষোভরত কৃষকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে হরিয়ানায়। কারণ বিক্ষোভ মূলত হয়েছে দিল্লি সীমানাবর্তী এ রাজ্যে। সেখানেই কৃষকরা যার যার মতো করে অবস্থান নিয়েছিলেন।

হরিয়ানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনীল ভিজ বলেন, সরকার বেশির ভাগ মামলা তুলে নিয়েছে। তিনি বলেন, বিক্ষোভের সময় মোট ২৭২টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ৮২টি মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে।’ কিন্তু এতেও কৃষকরা আশ্বস্ত হতে পারেননি।

কৃষক নেতা উরাগান বলেন, ‘এটা শুধু একটা রাজ্যের ব্যাপার নয়। কোন রাজ্যে কতটি মামলা হয়েছে, তার বিস্তারিত (কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে) আমাদের এখনো জানানো হয়নি। এ ছাড়া এর মধ্যে কতটি মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে, তাও আমরা জানি না।’ তবে সম্ভাব্য আরেকটি বিক্ষোভের জোর প্রস্তুতি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের মধ্যে এ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, তাদের আন্দোলন কিছুটা গতি হারিয়ে ফেলে কি না। কিছু নেতা পাঞ্জাবের প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও একটি আসন জিততে পারেননি। এরপর থেকেই কৃষক সংগঠনগুলোর মধ্যে অসন্তোষও রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর সংযুক্ত কিষান মোর্চা ৩২টি কৃষক ইউনিয়নের ২২টিকে বহিষ্কার করে। এসব ইউনিয়নের সদস্যরাই নির্বাচনে লড়েছিলেন।

উরাগান বলছেন, ‘এটা অবশ্যই কৃষকদের ঐক্যের বড় একটি আঘাত।’ কিন্তু তিনি একই সঙ্গে এও বলছেন যে তারা নিরাশ হননি। তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, একটা ফোনকলেই আবার আমরা একত্র হব। এই লড়াইয়ের আমরা অর্ধেক বিজয়ী হয়েছি এবং আমাদের এই লড়াই চলমান।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close