প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৫ মে, ২০২২

শিরিন আবু আকলেহ জীবন দিয়ে লেখা নাম

শিরিন আবু আকলেহ আরবের ঘরে ঘরে আক্ষরিক অর্থেই পরিচিত নাম। যুদ্ধ কিংবা শান্তি যেকোনো সময়ই অঞ্চলের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দেশের গ-ি ছাড়িয়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন বহু জায়গায়। তার শান্ত অথচ সদর্পে উপস্থিতি বসার ঘর থেকে যুদ্ধশিবির পর্যন্ত মুখর করে রাখত।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষত ফিলিস্তিনিদের নানা বিষয় নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে আসছিলেন এই নারী। কাজের মধ্যেই গত ১১ মে পশ্চিম তীরের জেনিনে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন ৫১ বছর বয়সি এই সাংবাদিক।

ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শিরিন কীভাবে ওই অঞ্চলে সাংবাদিকতায় ইতিহাস হয়ে উঠলেন তা বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।

শুরুটা ১৯৯৭ সালে, আরবি টেলিভিশন আলজাজিরা শুরুর পরের বছর থেকেই নিজের ইতিহাস নিজেই তৈরি করেছিলেন সাংবাদিক শিরিন। আরব নারীদের একটি প্রজন্মের কাছে সাংবাদিকতার চালিকাশক্তি ছিলেন শিরিন। তিনিই প্রথম নারী সংবাদকর্মী, যাকে তারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন, তাকে ‘আইকন’ মেনে নিজেদের তার আদলে তৈরির কথা ভেবেছেন বহু মানুষ।

গত ১১ মে ঘটনার দিন অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শিরিন, পরনের পোশাকে ‘প্রেস’ লেখাও ছিল, হঠাৎ একটি গুলি এসে তার গায়ে লাগে। শিরিন মারা যান। আলজাজিরার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, এটা ইসরায়েলি বাহিনীর ‘ঠাণ্ডা মাথায় খুন।’

ঘটনার পর শোক, ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিরিনকে আপনজন ভাবা ফিলিস্তিনিরা। সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন শিরোনামণ্ড ‘ট্রেইলব্লেজার, প্রতীক, শহীদ।’

ফিলিস্তিনিরা শিরিনকে আপন মানুষ ভাবত, তারা মনে করত, তিনি ‘তাদের কথা জানে, তাদের কথা বলে।’ পশ্চিম তীরের রামাল্লায় তার ছবি নিয়ে টানান হয়েছে বিশাল বিলবোর্ড। মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকে স্মরণ করছেন অনেকে। তবে সব ছাপিয়ে শিরিন একটি শিরোনাম অর্জন করেছেন কাজ এবং জীবন দিয়ে, সেটি হলো ‘সাংবাদিক’।

শিরিনের এক সহকর্মী লিনা আর শাফিন জানান, মৃত্যুর খবরটি তিনি প্রথম জেনেছিলেন তার আরেক সহকর্মী শায়মা খলিলের টুইটে। ‘ওহ! কী সাংঘাতিক খবর! আমি এবং লাখো মানুষ বছরের পর বছর ধরে শিরিনের খবর দেখে আসছি,’ বলেন লিনা।

তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলের বহু নারী আয়নার সামনে চুলের ব্রাশ ধরে (মাইক্রোফোন ভেবে নিয়ে) নিজেকে শিরিন ভেবে বড় হয়েছেন।’

লিনার ভাষ্যে, শিরিন ইসরায়েলিদের মধ্যেও তার জনপ্রিয়তা তৈরি করতে পেরেছিলেন। শিরিন আবু আকলেহ নিহত হওয়ার পর ক্ষোভের আগুন জ্বলছে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে। ১৯৯৩ সালে আরব বিশ্বে অসল চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে শিরিন ছিলেন যুদ্ধ এবং শান্তির কণ্ঠস্বর। ফিলিস্তিনিরা মনে করতেন, এই সাংবাদিক তাদেরই অংশ।

শিরিনের আত্মবিশ্বাস এবং হাসিমুখ তাকে সবার থেকে তাকে আলাদা করত বলে মনে করেন অনেক ফিলিস্তিনি। বিশেষ করে ২০০০ সালে মুক্তির আন্দোলনের সময় পশ্চিম তীরের প্রধান শহরগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনীর বড় ধরনের হামালার সংবাদ প্রকাশের জন্য অনেক ফিলিস্তিনি শিরিনকে স্মরণ করেন গভীরভাবে।

সেই উত্তরের শহরেই ইসরায়েলি অভিযানের খবর সংগ্রহে গিয়ে প্রাণ হারিয়ে শিরিন এখন সবচেয়ে বড় খবর হয়েছেন। যে মৃত্যু ফিলিস্তিন, আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে, ঢেকেছে শোকের ছায়ায়।

শিরিনের মরদেহের কাঠের কফিনটিতে গাঢ় সাদা অক্ষরে ‘প্রেস’ লেখা নীল দেহের বর্মটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং অন্যান্য যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করা সাংবাদিকদের শক্তি এবং বেদনার স্মারক বলে মনে করছেন তার সহকর্মীরা।

আরব সাংবাদিক এবং লেখক মারওয়ান বিশারা লিখেছেন, ভয়াবহ পরিস্থিতি, এমনকি রক্তাক্ত স্থানেও যখন থাকতেন শিরিন, তখনো শান্ত ও ধীরস্থির থাকতেন। এখন শিরিন নেই এই ধরনের অনেক খবর হারিয়ে যাবে বলে মনে করছেন অনেকে।

সাংবাদিক শিরিন হত্যায় হামাস নেতার প্রতিক্রিয়া : ইহুদিবাদী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করার জন্য ঐক্যবদ্ধ কমান্ড প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা ইসমাইল হানিয়া। ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে পূর্ব জেরুজালেমের পুরোনো শহরে আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার এই আহ্বান জানান তিনি। ইসমাইল হানিয়া বলেন, ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলন এখন নতুন অধ্যায়ে পৌঁছেছে যা ‘তীক্ষè ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত’ প্রত্যাশা করে। ঐক্যবদ্ধ কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা হলে তা বর্ণবাদী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত হবে।

সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর পাশবিক হত্যাকাণ্ড ঐক্যবদ্ধ কমান্ড প্রতিষ্ঠাকে অনিবার্য করে তুলেছে বলেও মন্তব্য করেন এ হামাস নেতা। এ ছাড়া তেল আবিবের সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতার অবসান এবং কথিত অসলো শান্তিচুক্তি বাতিলের জন্য রামাল্লাভিত্তিক ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান ইসমাইল হানিয়া। গত বুধবার পশ্চিমতীরের জেনিন শহরে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করে শিরিন হত্যা করেন।

শিরিন হত্যার নিন্দা জানাল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ : সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে হত্যার ঘটনায় সর্বসম্মতভাবে নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। কূটনীতিকদের বরাতে এ তথ্য জানায় আলজাজিরা। ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মতভাবে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া বিরল ঘটনা। শিরিনের হত্যার বিষয়ে ‘একটি দ্রুত, পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত’ করার আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস অফিসও এ হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছে। তাদের মতে, এটি যুদ্ধাপরাধ হতে পারে। এএফপিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক জানান, শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা বিশেষভাবে দুঃসাধ্য ছিল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close