প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ০৫ আগস্ট, ২০২১

উৎকণ্ঠায় আফগানরা

তালেবান আতঙ্কে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা হাজারো বাসিন্দার

আফগানিস্তানে ফের বিভিন্ন শহর ও এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে তালেবান। এতে আতঙ্ক বাড়ছে দেশটির সাধারণ বাসিন্দাদের। এরই মধ্যে অনেকে দেশ ছাড়ারই পরিকল্পনা নিয়েছেন। এদেরই একজন আবদেল খালিদ নবিয়ার। তালেবান যখন বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, তখন দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি। তার ভাষ্য, পরিস্থিতি আরো খারাপ হলেন তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন।

শুধু নবিয়ার নন, তার মতো হাজারো মানুষ আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন। এজন্য আফগানিস্তানের পাসপোর্ট অফিসে ধরনা দিচ্ছেন তারা। সম্প্রতি পাসপোর্ট অফিসের বাইরে এমন হাজারো মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে। খবর এএফপির।

আফগানরা যে দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তার মূল কারণ নিরাপত্তার অভাব। আর এ অভাব আফগান যুদ্ধের ফসল। এর সূচনা ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আল কায়েদার হামলাকে কেন্দ্র করে। ওই হামলার পর ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ নতুন এক লড়াই শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। আর এজন্য তারা পাশে পায় অন্য পশ্চিমা দেশগুলোও। আল কায়েদার শীর্ষ নেতাদের আশ্রয় দেওয়া ও পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আফগানিস্তানে হামলা চালায় তারা। এরপর আফগানিস্তানের ক্ষমতার মসনদ ছাড়তে বাধ্য হয় তালেবান। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো ও মার্কিন সেনাদের মুহুর্মুহু হামলায় সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হয় তালেবান। একটা সময় বিদেশি বাহিনীর সহায়তায় প্রায় পুরো দেশ আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণ আবারও খোয়াতে শুরু করেছে আফগান সরকার।

আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের নতুন সূচনা হয়েছিল ২০০৫ সালে দিকে। তবে সেই সময় সম্মুখ সমর থেকে সরে এসে তালেবান নতুন কৌশল নেয়। তারা আত্মঘাতী হামলার পথ বেছে নেয়। এতে খানিকটা ‘সফলও’ তারা। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত তারা ৬৪টি আত্মঘাতী হামলা চালায়। আফগানিস্তানের জন্য এটা ছিল একেবারে নতুন ঘটনা। এ হামলা দিন দিন তীব্র হতে থাকে। শুধু ২০০৭ সালের নভেম্বরে এমন আত্মঘাতী হামলায় ৭০ জন প্রাণ হারায়।

যুদ্ধে আফগানিস্তানে যে ক্ষতি হয়েছে তা আসলে অপূরণীয়। এর একটা আংশিক হিসাবও দেওয়া যেতে পারে। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, তালেবানের উত্থানের পর ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৮ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এ সময়ের ব্যবধানে ৭০ হাজার আফগান আহত হয়েছেন। আর সর্বশেষ তিন বছরে এ হামলা আরো বেড়েছে। আফগানিস্তানের শরণার্থী ও প্রত্যাবাসনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে, সরকারি বাহিনী ও তালেবানের সংঘর্ষের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় চার লাখ মানুষ।

ক্ষতি শুধু আফগানিস্তানের জনগণের হয়েছে, এমনটা নয়; মার্কিন ও বিদেশি বাহিনীকেও এর খেসারত দিতে হয়েছে। আফগানিস্তানে এ পর্যন্ত মার্কিন বাহিনীর আড়াই হাজার সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি সেনা। ন্যাটোর হিসাব অনুসারে, মার্কিন বাহিনীর পরই ক্ষতি তালিকায় ব্রিটিশ বাহিনী। এ বাহিনীর প্রায় সাড়ে ৪০০ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। আফগানিস্তানের সরকার অবশ্য তাদের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দেয় না। তবে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি বলেছিলেন, ২০১৪ সাল থেকে আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীর ৪৫ হাজারে বেশি সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন।

এ যুদ্ধের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তাও অপূরণীয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের হিসাব অনুসারে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে খরচ করেছে ৭৮ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আফগানিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। তবে পেন্টাগনের এ হিসাবের সঙ্গে হিসাব মেলে না যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষণার। তারা বলছে, মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর যে অর্থ সহায়তা দিয়েছে, তা এই হিসাবের মধ্যে নেই। এ ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে অর্থ ব্যয় করে, তাও নেই এ হিসাবে। এমনকি হিসাবে নেই সেনাদের চিকিৎসা খরচও। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষণা অনুসারে, সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ মার্কিন যুদ্ধে ব্যয় সাড়ে ছয় ট্রিলিয়ন ডলার।

২০০১ সালের পর সময় যত গড়িয়েছে, তত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তালেবান। এ ছাড়া গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি এবং চলতি বছর সেনা প্রত্যাহার শুরুর পর আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তালেবান। এ লক্ষ্যে হামলাও বাড়িয়েছে তারা। তালেবান এ পর্যন্ত ২২৩টি জেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ১১৬টি জেলায় লড়াই চলছে। দেশটির ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ১৭টির রাজধানী তালবানের দখলে চলে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে। এর মধ্যে হেলমান্দ প্রদেশের রাজধানী লঙ্করগাহ এখন অবরুদ্ধ।

শুধু লঙ্করগাহের নাগরিকরা যে অবরুদ্ধ, এমনটা নয়; যে এলাকাগুলোয় তালেবান ও সরকারি বাহিনীর লড়াই চলছে, সেখানকার বাসিন্দারাই অবরুদ্ধ। এ কারণে দেশ ছাড়াটাকেই বাঁচার পথ হিসেবে দেখছেন তারা। আর সেই নবিয়ারের জন্য এটা খানিকটা অপরিহার্য বলা যায়। কারণ ন্যাটোর একটি ঘাঁটিতে তার দোকান। এ কারণে নিজেকে অনেক বেশি অনিরাপদ মনে করেছেন তিনি। নবিয়ারের ভাষ্য, সবাই এখনই দেশ ছাড়বেন, এমনটা নয়। তারা নিরাপত্তার জন্য পাসপোর্ট সংগ্রহ করছেন, যাতে খুব অল্প সময়ে দেশ ছাড়া যায়।

ফলে, রাজধানী কাবুলের পাসপোর্ট অফিসে ‘দেশ ছাড়তে ইচ্ছুকদের’ ভিড় চোখে পড়ার মতো। সূর্যোদয়ের আগেই সেখানে লাইন দাঁড়াতে দেখা যায় অনেককে। আর পাসপোর্ট নিয়ে জনগণের এই আগ্রহে খানিকটা বিরক্ত পাসপোর্ট অফিসের কর্মীরা। তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, আগে প্রতিদিন পাসপোর্টের আবেদন জমা পড়ত ২ হাজার, তা এখন ৫ গুণ বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার।

বলা যায়, তালেবান অনিশ্চয়তার বীজ বপন করেছে আফগানিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে। আর এ ভয়ে বেশি ভীত দেশটির শিক্ষিত নারীরা। এমনই একজন জিনাত বাহার নাজারি। তিনিও পাসপোর্ট নিতে আগ্রহী। এজন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার পরিবারের সদস্যরা বলতেন, তালেবান মানুষ মারছে। তাদের হাতে মানুষ গুম হচ্ছে।’ তালেবানকে নিয়ে কম্পিউটার সায়েন্সের এই শিক্ষার্থীর পর্যবেক্ষণ হলো, ‘নারীদের প্রতি সহিংস তালেবান যোদ্ধারা। তারা চায় না নারীরা শিক্ষিত হোক। মৌলিক অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করতে চায় তালেবান।’

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেছে তালেবান। এ সময় খুব ছোট ছিলেন নাজারি। কিন্তু তিনি জানেন, তালেবান সেই সময় কী করেছে। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু এটা জানি যে তালেবান সন্ত্রাসী সংগঠন। আপনি যখন পড়াশোনা করবেন, তখন একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা করবেন। কিন্তু তালেবান যদি ক্ষমতা গ্রহণ করে, তবে আপনার এই প্রত্যাশায় গুড়ে বালি।’ তালেবানকে ও দেশের পরিস্থিতিকে একইভাবে দেখেন সরদার (৫২)। তিনি বলেন, ‘আমাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে। কিন্তু আমাদের কোনো কিছু বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই।’

অনিশ্চয়তা, ঝুঁকি ও হুমকির মুখে আফগানরা। এর মধ্যেই তাদের বসবাস। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছেন। কিন্তু জানেন না, তারা কোথায় যাবেন বা আদৌ যেতে পারবেন কি না। তবে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন দেশ ছাড়ার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close