প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

পাকিস্তানে জে. নিয়াজীকে যেভাবে দেখা হতো

লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী (একে নিয়াজী) ছিলেন শেষ যুদ্ধবন্দি, যাকে ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে লাহোরের ওয়াঘা পোস্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। ওয়াঘা পোস্টে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যখন তাকে শেষ যুদ্ধবন্দি হিসেবে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করে তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল নিয়াজীর ভাতিজা শের আফগান খান নিয়াজী। এ ঘটনার সময় শের আফগান নিয়াজী সবেমাত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি ব্রিগেডিয়ার পদ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হন এবং পরে অবসরে যান।

চাচা নিয়াজীর বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে শের আফগান খান নিয়াজী বিবিসিকে বলেন, ‘সেসময় কেউই আমাদের জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে দেখা করার বা কথা বলার অনুমতি দেয়নি। তাকে লাহোর ক্যান্টনমেন্টের কর্পস হেডকোয়ার্টারে, যেটি জিন্নাহ হাউজ নামে বিখ্যাত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।’

লাহোর থেকে শের আফগান নিয়াজী সোজা কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে চলে যান। সেখানে তার ট্রেনিং শুরু হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য তার ইচ্ছা বা স্বপ্নের পেছনে মূল প্রেরণাদায়ক হিসেবে চাচা জেনারেল নিয়াজী ছিলেন বলে জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত এ ব্রিগেডিয়ার শের আফগান।

লাহোরের কর্পস হেড কোয়ার্টারে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শেষে জেনারেল নিয়াজী সড়কপথে তার নিজের এলাকা মিয়ানওয়ালীতে যান। সেখানে পুরো নিয়াজী গোত্রের লোকজন তাকে স্বাগত জানায় এবং উষ্ণ অভ্যর্থনা দেয়।

শের আফগান নিয়াজী বলেন, ‘আমি এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নই কারণ আমাকে কাকুল একাডেমিতে যেতে হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এ সংবর্ধনা মিয়ানওয়ালীর লোককাহিনীর অংশ। নিয়াজী গোত্রের প্রধান যখন জেনারেল নিয়াজীকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন তখন শহরের প্রবেশপথে এ গোষ্ঠীর অন্যসব ছোট ছোট গোষ্ঠীর মানুষরাও উপস্থিত ছিল।’

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শের আফগান জানান, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার বাবা লাহোরের একটি ডিভিশনের কমান্ডার থাকাবস্থায় জেনারেল নিয়াজীর স্টাফ অফিসারের কাছ থেকে একটি ফোন পেয়েছিলেন। তাতে তাকে নিয়াজীর সঙ্গে এসে দেখা করতে বলা হয়েছিল।

‘আমি বাবার সঙ্গে লাহোরে গিয়েছিলাম, ‘সেখানে আমাদের বলা হয়েছিল জেনারেল নিয়াজীকে পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেই সন্ধ্যায় তার প্রস্থানের আগে সেটাই ছিল তার সঙ্গে আমাদের শেষ সাক্ষাৎ’ বলেন শের আফগান নিয়াজী।

তিনি বলেন, ‘আমরা তাকে আনন্দ নিয়েই বিদায় জানাই এবং আমরা চলে যাওয়ার সময় তিনি আমাদের তার জন্য দোয়া করতে বলেন।’

সেনাবাহিনীর ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্সের (আইএসপিআর) সেসময়কার প্রধান ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী ২০০৪ সালে জেনারেল নিয়াজীর মৃত্যুবার্ষিকীতে স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে কলাম লিখেছেন। তাতে লিখেন- ‘সাহসিকতার জন্য বিখ্যাত জেনারেল নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিং গ্রহণ করেছিলেন। যখন কিনা লেফটেন্যান্ট জেনারেল বাহাদুর শের, যিনি জেনারেল নিয়াজীর মতোই ‘মিলিটারি ক্রস’ (ব্রিটেনের সর্বোচ্চ সামরিক পুরস্কার) পেয়েছিলেন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পোস্টিং গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।’

শের আফগান জানান, ‘দুই বা তিনজনের বেশি জেনারেল পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টিংয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। জেনারেল নিয়াজী এ পোস্টিংয়ের সঙ্গে জড়িত বিপদ মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা না করেই হ্যাঁ বলেছিলেন।’

প্রথমদিন থেকেই সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি কোনো হস্তক্ষেপ সহ্য করেননি অথবা তিনি তার পূর্বসূরি এবং সিনিয়র জেনারেল টিক্কা খানের পরামর্শে কান দেননি বলে জানান শের আফগান।

একই স্থানে অবস্থানরত দুই জেনারেলের মধ্যে এ পরিস্থিতি একটা উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। যদিও সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার একই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাদের।

অবসরপ্রাপ্ত এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘মিয়ানওয়ালীর নিয়াজী গোত্র এবং বৃহত্তর পরিবারের সদস্যদের এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, জেনারেল নিয়াজী এ মাটির একজন সাহসী সন্তান।’

সেনা কর্মকর্তা হিসেবে ব্রিগেডিয়ার আফগানের পেশাগত জীবন জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, কারণ সেনাবাহিনীতে তার কর্মজীবন জেনারেল নিয়াজীর ‘সতর্ক নজরে’ কেটেছিল।

শের আফগান বলেছেন, ‘একবার কাকুলের পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে জেনারেল নিয়াজী আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তার এ আগমন একাডেমিতে একটা বড় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’

‘সেখানে আমি একজন প্রশিক্ষণার্থী ছিলাম এবং জেনারেল আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং তিনি আমার সঙ্গে বিশ মিনিট ছিলেন। সেখানে তাকে দেখে সবাই খুব অবাক হয়েছিল।’

ভারতীয় বন্দি অবস্থা থেকে ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে মুক্তি এবং ২০০৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চাচার সঙ্গে অসংখ্য বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা করেছেন বলে জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত এ ব্রিগেডিয়ার। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ক্রমাগত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য যেসব কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।’

জেনারেল নিয়াজী বারবার একটি স্থানীয় এবং ‘বিকেন্দ্রীভূত’ প্রতিরক্ষা কৌশলের ধারণা নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন যেটা তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গ্রহণ করেছিলেন বলে জানান শের আফগান। তিনি আরো জানান, সাধারণত এ আলোচনা পূর্ব পাকিস্তানের স্থানীয় প্রতিরক্ষা থেকে বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে জেনারেল নিয়াজী বেশিরভাগই বিশ্বের সামরিক ইতিহাসের বই পড়তেন।

এখানে জেনারেল নিয়াজীর পরিবারের সদস্যরা কীভাবে একজন সেনাবাহিনীর জেনারেলকে মনে রেখেছেন তার একটি সার-সংক্ষেপ দেওয়া হয়েছে।

যাকে পূর্ব পাকিস্তান ট্র্যাজেডির তদন্তকারী বিচারক এবং সরকারি কর্মকর্তারা আর্থিক এবং নৈতিক উভয় দিক থেকে একজন অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে অবস্থান নেয় তখন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ঢাকায় ভারত-বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

এ পরাজয়ের পরে জেনারেল নিয়াজীর নাম জনগণের সামনে একটি অসম্মানের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রেহমানের নেতৃত্বে গঠিত যুদ্ধ তদন্ত কমিশন ১৯৮২ সালে জেনারেল নিয়াজীকে তলব করে স্বীকারোক্তি দিতে বলেছিল।

পূর্ব পাকিস্তানে কর্তব্য পালনকালে একাধিক নৈতিক অসদাচরণের অভিযোগে নিয়াজীকে দোষী সাব্যস্ত করে যুদ্ধ কমিশন।

তার বিরুদ্ধে কমিশন দুর্নীতি এবং নৈতিক স্খলনের অভিযোগ এনেছিল। তিনি আদেশের বিরোধিতাকারী অধস্তন কর্মকর্তাদের হয়রানি এবং লাঞ্ছনা করেছিলেন বলে সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্যদিকে জেনারেল নিয়াজী এ সামরিক পরাজয়ের জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রশাসনকে দোষারোপ করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমিশন তার এ অভিযোগগুলো গ্রহণ করে তাদের সমালোচনা করেছিল। কমিশন উল্লেখ করেছিল পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন জেনারেল নিয়াজী এবং সেখানে যা কিছু ঘটেছে তার সবকিছুর জন্যই তিনি দায়ী। ২০০৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জেনারেল নিয়াজী লাহোরে মারা যান। সেখানকার সামরিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

ভারতের কারাগারে চার বছর থাকার পর মুক্তি মেলে তার। পরে আর সেনাবাহিনীতে ফিরে যাননি তিনি। নিজের শহরে অবসর পরবর্তী সময় কাটান জেনারেল নিয়াজী। যদিও তার পরবর্তী প্রজন্ম সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছিল। জেনারেল নিয়াজী তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, তার এক ছেলে এবং একজন ভাতিজা সেনা কর্মকর্তা হয়েছিলেন।

ভারত থেকে ফেরার পর ‘দ্যা ব্রিটেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ অর্থাৎ (পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা) শীর্ষক বই লেখেন জেনারেল নিয়াজী।

এ বইয়ে তিনি লিখেছেন যে, নিয়াজীরা যোদ্ধাগোষ্ঠী যারা প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে ‘সামরিক যোদ্ধাদের’ জন্য কাজ করে আসছে।

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার শের আফগান বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন আমি উপলব্ধি করতাম জেনারেল নিয়াজীর ভারতীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিত হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।’

‘সেনাবাহিনীতে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করতাম এবং আমি সেনা কর্মকর্তাদের বলতাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া জেনারেল নিয়াজীকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন। ইয়াহিয়া তাকে (জেনারেল নিয়াজী) বলেছিলেন যে, আমরা পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে বলি দিতে পারি না’ বলেন শের আফগান।

যখন শের আফগানকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, সেনাবাহিনীতে একটি সাধারণ কথা প্রচলিত রয়েছে, ‘যে মারা যায় সে শহীদ, যে বেঁচে থাকে সে গাজী এবং যে পালিয়ে যায় সে নিয়াজী।’ প্রত্যুত্তরে শের আফগান বলেছিলেন- জেনারেল নিয়াজীকে নিয়ে সেনাবাহিনীতে কোনো নেতিবাচক ধারণা নেই। অবসরপ্রাপ্ত এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, সেনা ব্যারাক থেকে একথা আসেনি বরং ভারত এর জন্য দায়ী।

‘জেনারেল নিয়াজীকে হেয় করার উদ্দেশ্যে অল ইন্ডিয়া রেডিও ছড়িয়ে দিয়েছিল। জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অত্যন্ত সুদক্ষ কর্মকর্তা ছিলেন’ বলেন শের আফগান। পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে যেসব রাজনীতিবিদ জেনারেল নিয়াজীকে নিয়ে উপহাস করেন তাদের প্রতি গভীর দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিয়াজীর বংশের সেনা কর্মকর্তা শের আফগান।

‘আমি এ রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে কিছু বলব না, কিন্তু আমাদের পরিবার এবং নিয়াজী বংশের মনোভাব এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে যে, পাকিস্তানে জেনারেল নিয়াজীর চেয়ে সাহসী আর কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করেনি’ বলেন শের আফগান। তিনি জানান, জেনারেল নিয়াজী তার পরিবারের কাছে খুবই দয়ালু এবং ভদ্র ব্যক্তি ছিলেন।

‘যুদ্ধবন্দি হিসেবে মেয়াদ কাটিয়ে ফেরার পর তার ব্যক্তিত্বে আমরা কোনো পরিবর্তন দেখতে পাইনি’ বলেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা। তিনি আরো জানান, জেনারেল নিয়াজীর দুই ছেলেই সম্প্রতি মারা গেছেন তবে তার তিন মেয়ে এখনো জীবিত আছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close