নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ঘুষের টাকায় কোটিপতি ভূমি কর্মকর্তা আবদুস সালাম

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের আমলে মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন ভূমি অফিস অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। খতিয়ান, দাগ নম্বর, নামজারিসহ ভূমির যেকোনো কাজে ঘুষ বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা শুরু করেছিলেন তৎকালীন ইউপি ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আবদুস সালাম। শাস্তি হিসেবে দুই দফা বদলির পর বর্তমানে তার জায়গা হয়েছে শিবচর উপজেলার মাদবরেরচর ইউনিয়নে। শুধু তাই নয়, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী তহশিলদার হিসেবে পদোন্নতিও বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে বদলি ও পদোন্নতি সত্ত্বেও ঘুষ-বাণিজ্য ছাড়েননি ভূমি কর্মকর্তা আবদুস সালাম। ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজ উপজেলার কুলপদ্দি এলাকায় করেছেন অর্ধকোটি টাকার বাড়ি। রয়েছে নামে-বেনামে সম্পত্তি।

মাদারীপুরের বাঁশগাড়ী ইউনিয়নে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় থেকে শুরু করে নামজারি ও দেওয়ানি ব্যক্তি মালিকানা মামলার প্রতিবেদন ও ভূমিসংক্রান্ত প্রতিটি কাজে ঘুষ নেওয়ার একাধিক অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বদলির আগে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করেননি বলে জানিয়েছেন একাধিক ভুক্তভোগী। ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান করার জন্য অনলাইনে আবেদন করলে ভূমি কর্মকর্তা আবেদন বাতিল করে, পরে ঘুষ নিয়ে তালিকাভুক্তি করেন বলেও জানিয়েছে একাধিক সূত্র। সূত্র বলছে, বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন ভূমি অফিসে প্রতিটি নামজারির জন্য ৮ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন আবদুস সালাম। কিন্তু প্রতিটা নামজারির জন্য সরকারের নির্ধারিত ফি মাত্র ১১৭০ টাকা। জনসাধারণ নিজে অনলাইনে নামজারির জন্য আবেদন করলে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বাতিল করে দেন তিনি, যাতে ঘুষ খাওয়া যায়।

ভুক্তভোগীরা জানান, ভূমি কর্মকর্তা আবদুস সালাম খতিয়ানের কপি তুলতেই মোটা অঙ্কের বিল ধরিয়ে দেন। ভূমি উন্নয়ন করের অর্ধেক টাকা দিলেই কাজ করে দেন। যারা ঘুষ দেন না, তাদের ঝামেলা তৈরি করেন। ‘সরকারের কোষাগারে আমি যত টাকা জমা করি, এ নিয়ে কোনো আপত্তি করতে পারবেন না এবং কাউকে জানাতে পারবেন না। জানালে জেল হতে পারে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। যদি তার কথায় রাজি থাকেন, তবেই কাজ করে দেন। নিরুপায় হয়ে কর্মকর্তার কথামতো টাকা দিতে হয় সাধারণকে।

খোঁজ জানা গেছে, ভূমি কর্মকর্তা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ৩০ বছরের বিল নিয়ে সেখান থেকে ১ থেকে ২ বছরের ভূমি উন্নয়ন কর সরকারী কোষাগারে জমা দেন, বাকি টাকা ভরেন নিজের পকেটে। খতিয়ানের জন্য বেশি টাকা জমা নিয়ে দাখিলা দেন অল্প টাকার। সোহরাব মোল্লা নামের এক ভুক্তভোগী জানান, ১২৮ নং কানুরগাঁ মৌজার ৪৪নং খতিয়ানের জন্য ১৩ হাজার টাকা নিয়েছে উপসহকারী আবদুস সালাম। তিনি ২৩২৪-০০২০০৮৮৪০০নং চালান এর মাধ্যমে মাত্র ১২৩৩ টাকা জমা করেন। এর আগেও ভুক্তভোগীর কাছে থেকে ৯ হাজার টাকা নিয়ে ৯৫০ টাকার দাখিলা দেন। বাকি টাকা আত্মসাৎ করেন।

সিরাজুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী জানান, তার কাছে থেকে কৌশলে ১২৪নং স্নানঘাটা মৌজার ৪২২নং খতিয়ানের দাখিলার জন্য ১০ হাজার টাকা নেন আবদুস সালাম। ৫৪৪০২৩০২৬৭৮৬নং চালানে মাত্র তিনি ৪ হাজার ৬৯০ টাকা জমা করেন সরকারি কোষাগারে। বাকি টাকা তার পকেটে রেখে দেন। নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি নামজারি করতে গেলে তার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। নিজে আবেদন করার কথা বললে ভূমি কর্মকর্তা তার আবেদন বাতিল করে দেওয়ার হুমকি দেন। নুরুল ইসলাম জানতে চান, ‘আপনি কোনো কারণ দেখিয়ে বাতিল করবেন, কেননা আমার কাগজে তো কোনো ভুল নাই।’

ভূমি কমর্কর্তা সালাম তাকে জবাব দেন, ‘ভুল না থাকলে, ভুল পয়দা করে বাতিল করব। এসিল্যান্ড বলেন, ডিসি বলেন, আমরা একই পরিবারের লোক। যার কাছে যান কোনো লাভ নেই। আমার মাধ্যমে যারা নামজারি করে তাদের সামান্য নামে ভুল থাকলে যেমন আবদুল করিম আছে পর্চায় আর দলিলে আছে আবদুল করিম মিয়া। এ মিয়া থাকার কারণে উপজেলা সার্ভেয়ারকে আমার ৫ হাজার টাকা দিতে হয়।’ এমন কথা শুনে নুরুল ইসলাম ডিসির কাছে সাহায্যের জন্য যান। সেখান থেকে তারা এসিল্যান্ডের কাছে পাঠালে নুরুল ইসলাম তার নামজারি মাত্র ১,১৭০ টাকায় করেছেন। ভুক্তভোগী আ. রাজ্জাক মোল্লা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি পেশায় পান বিক্রেতা। আমার কাছ থেকে নামজারির জন্য ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়েছে ভূমি কর্মকর্তা।’

রাজ্জাক মোল্লার সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি কষ্ট করে টাকা দিয়ে জমি কিনেছি। রেকর্ড জরিপে বাড়িতে না থাকায় আমার নামে আরএস রেকর্ড করাতে পারিনি। তাই আমার নামজারি করা দরকার হয়। তাই উপসহকারী আবদুস সালামের কাছে নামজারি করতে গেলে আমার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা চান। পরে আমি তাকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিই। পরে তিনি আমার নামজারি করে দেন এবং তিনি আমায় নামজারির কাগজ দেওয়ার সময় বলে দেন যে, ‘কারো কাছে টাকার কথা বললে এসিল্যান্ডকে দিয়ে নামজারি বাতিল করে দেব এবং জেলও দিতে পারে কিন্তু।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি সহকারী তহশীলদার আবদুস সালাম বলেন, আপনি নিউজ করতে পারেন। আমার কেউ কিছু করতে পারবে না। আমার বিরুদ্ধে কোনো ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ নাই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close