মো. মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)
ভিসা জটিলতায় যাত্রী কমেছে বেনাপোলে
আগে প্রতিদিন ৭ থেকে ৯ হাজার যাত্রী পারপার হলেও এখন এক থেকে দেড় হাজারে নেমে এসেছে * রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

যশোরের বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট এলাকা এখন কোলাহলমুক্ত, নেই যাত্রীচাপ। প্রতিদিন অলস সময় কাটাচ্ছেন এখানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে ভারত সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় কমেছে দুদেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার। আগে প্রতিদিন যেখানে ৭ থেকে ৯ হাজার যাত্রী পারাপার হত, এখন সেখানে প্রতিদিন পারাপার হচ্ছে দেড় থেকে দুই হাজার যাত্রী। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ রেখেছে ভারত। এতে কমে গেছে যাত্রী যাতায়াত। ভিসা বন্ধ থাকায় দুদেশের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন নাগরিকরা। বেনাপোল বন্দর থেকে ভারতের কলকাতা শহরের দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। ভ্রমণ, ব্যবসা, চিকিৎসা বা অন্যান্য কাজে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াতকারীদের বড় অংশ ব্যবহার করেন বেনাপোল-পেট্রাপোল রুট।
ইমিগ্রেশন সূত্র জানিয়েছে, ২০ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতে গেছে ১০ হাজার ৯৮৯ জন আর ভারত থেকে এসেছে ১০ হাজার ৪৬০ জন পাসপোর্টযাত্রী। ১১ দিনে পারাপার হয়েছে মোট ২১ হাজার ৪৪৯ জন যাত্রী। তবে এদের মধ্যে ভারতীয় পাসপোর্টযাত্রী আসা ও যাওয়া অনেকাংশে বেড়েছে। এ ১১ দিনে ভারত থেকে এসেছে ৪ হাজার ৭৬৪ জন ও ভারতে ফিরে গেছে ৫ হাজার ৩৮২ জন ভারতীয় যাত্রী। এদের মধ্যে ভারত থেকে বিজনেস ভিসা নিয়ে আসা ল্যাগেজ পার্টি যাত্রীর সংখ্যা বেশি। যাত্রী পারাপার কমে যাওয়ায় ‘ভ্রমণকর’ বাবদ রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর থেকে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, বছরে এ বন্দরে ভ্রমণকর থেকে রাজস্ব আদায় হয় ১৮২ কোটি টাকা। ৫ আগস্টের আগে প্রতি মাসে গড়ে ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হত। বর্তমানে রাজস্ব আদায় হচ্ছে মাসে ৩ কোটি টাকা। ইমিগ্রেশন সূত্র জানিয়েছে, বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে ২০ জানুয়ারি ১ হাজার ৭৮০ জন যাত্রী পারাপার হয়েছে, এর মধ্যে ভারতে গেছে ১ হাজার ৬৭ জন, এসেছে ৭১৩ জন। ২১ জানুয়ারি ৩ হাজার ৩২ জন যাত্রী পারাপার হয়েছে, এর মধ্যে ভারতে গেছে ১ হাজার ৫৭০ জন, এসেছে ১ হাজার ৪৬২ জন। ২২ জানুয়ারি পারাপার হয়েছে ১ হাজার ৮২৪ জন, এর মধ্যে ভারতে গেছে ৯৭৩ জন, এসেছে ৮৫১ জন। ২৩ জানুয়ারি পারাপার হয়েছে ১ হাজার ৮২৮ জন, এর মধ্যে ভারতে গেছে ৯৩৭ জন, এসেছে ৮৯১ জন। ২৪ জানুয়ারি পারাপার হয়েছে ১ হাজার ৮৪৭ জন, এর মধ্যে ভারতে গেছে ৯৫৪ জন, এসেছে ৮৯৩ জন। ২৫ জানুয়ারি পারাপার হয়েছে ১ হাজার ৫১৩ জন, এর মধ্যে ভারতে গেছে ৬৬৮ জন, এসেছে ৮৪৫ জন। ২৬ জানুয়ারি পারাপার হয়েছে ১ হাজার ৮১১ জন, এর মধ্যে ভারতে গেছে ৮৭০ জন, এসেছে ৯৪১ জন। ২৭ জানুয়ারি পারাপার হয়েছে ১ হাজার ৯৭১ জন, এর মধ্যে ভারতে গেছে ১ হাজার ৭৪ জন, এসেছে ৮৯৭ জন। ২৮ জানুয়ারি পারাপার হয়েছে ১ হাজার ৯৪৩ জন, এর মধ্যে ভারতে গেছে ৯৮২ জন, এসেছে ৯৬১ জন। ২৯ জানুয়ারি পারাপার হয়েছে ২ হাজার ২৮১ জন, এর মধ্যে ভারতে গেছে ১ হাজার ১২১ জন, এসেছে ১ হাজার ৬০ জন ও ৩০ জানুয়ারি পারাপার হয়েছে ১ হাজার ৬১৯ জন, এর মধ্যে ভারতে গেছে ৭৭৩ জন, এসেছে ৮৪৬ জন। বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যায় কেবল সেইসব যাত্রী প্রত্যেকেই ‘ভ্রমণ কর’ বাবদ এক হাজার টাকা এবং ‘প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল’ ফি বাবদ ৫৫ টাকা দিয়ে থাকেন। ফেরত আসা যাত্রীরা এ করের আওতামুক্ত। স্বাভাবিক সময়ে বেনাপোল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪ হাজার থেকে পাঁচ হাজার যাত্রী ভারতে যেত। এখন সেটা কমে গড়ে ৮০০ থেকে এক হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রফিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশিদের বিদেশ ভ্রমণ কমে গেছে মূলত ভিসা প্রাপ্তি জটিল হওয়ার কারণে। বর্তমানে ভারত ভিসা দিচ্ছে না। গত কয়েকমাসে যারা ভারত ভ্রমণ করেছেন, তাদের বেশিরভাগের ভিসাই আগে ইস্যু করা। ভারতের ভিসা সীমিত থাকায় সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশি পর্যটকের বিদেশযাত্রা আরো কমবে। যার প্রভাব পড়েছে সরকারের ভ্রমণকর আদায়ের ক্ষেত্রে। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় নড়াউলের গণেশ সাহা, ঢাকার সোমেন শীল গত শনিবার ভারত থেকে ফিরেছেন।
গণেশ সাহা বলেন, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তাই তড়িঘড়ি করে ভারতে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে একটু দেখা করে আসলাম। তাদের সঙ্গে দেখা করাও হলো আবার বেড়ানও হলো। সোমেন শীল বলেন, ভিসার মেয়াদ এ মাসেই শেষ হবে যাবে। তাই ভারতে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম।
বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছেন ভারতীয় নাগরিক আবুল কালাম। বেনাপোল চেকপোস্টে আবুল কালাম বলেন, অন্য সময় বেনাপোল চেকপোস্টে খুব ভিড় থাকত। এবার কোনো যাত্রীর ভিড় নেই। খুব ভালো লাগছে।
বেনাপোলের ফাইভ স্টার পরিবহনের ম্যানেজার আশাদুজ্জামান আশা বলেন, ভিসা বন্ধ থাকায় তাদের পরিবহন ব্যবসায় লোকশান গুনতে হচ্ছে। একই কথা বলেন, আলম মানিচেঞ্জারের স্বত্বাধিকারী মশিয়ার রহমান। তিনি বলেন, ভারতে চিকিৎসা, ব্যবসা, ছাত্রসহ বিভিন্ন কাজে এ পথে যেত আগে প্রায় ১০ হাজার লোকের উপরে যাত্রী। তাতে তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ডলার কেনাবেচা হত। এতে করে কর্মচারীসহ নিজেরা স্বাচ্ছন্দে কেটে যেত। বর্তমান যে অবস্থা অফিস চালানো দুস্কর হয়ে পড়েছে।
বেনাপোল গ্রীন লাইন পরিবহনের ম্যানেজার রবীন্দ্রনাথ বলেন, তাদের এসি গাড়ি। সামান্য কয়েকজন যাত্রী নিয়ে রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে যেতে হয়। এতে তাদের গাড়ির তেল খরচ হচ্ছে না। তিনি বলেন, এখানে থেকে যেসব পরিবহন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ছেড়ে যায় তারা সবাই পড়েছে বিপাকে।
বেনাপোল আমদানি-রপ্তানি সমিতির সহসভাপতি ও যমুনা ট্রেডিং করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী আমিনুল হক বলেন, ভারত ভিসা বন্ধ রাখায় আমাদের ব্যবসায়িক কাজেও সংকট দেখা দিয়েছে। আমদানি-রপ্তানির কাজে পণ্যের গুণগতমান যাচাইয়ের জন্য ব্যবসায়ীদের ভারত যাতায়াত করা লাগে। বর্তমানে ভিসা না থাকায় তারা ভারত গমন করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ-ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক (ল্যান্ডপোর্ট) মতিয়ার রহমান বলেন, ভিসাকেন্দ্রগুলো এখন কেবল জরুরি মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য সীমিত পরিসরে স্লট দিচ্ছে। ব্যবসা ও ভ্রমণ ভিসার যাত্রীদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ভারত ভিসা সেবা বন্ধ রাখায় ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা কিংবা অন্যান্য কাজে বাংলাদেশিরা যেমন যেতে পারছেন না, তেমনি ক্ষতির মুখে পড়ছেন ভারতীয়রাও।
বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার বলেন, ভিসা জটিলতা না কাটলে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই যাত্রী পারাপার শূন্যের কোটায় এসে দাঁড়াবে। এখন যারা যাতায়াত করছে এদের অধিকাংশের ভিসার মেয়াদ শেষের দিকে। বন্দরের রাজস্ব আয় অনেকটা কমে গেছে।
"