সিরাজগঞ্জ ও তাড়াশ প্রতিনিধি
তিনশ বছরের ঐতিহ্য তাড়াশ দইমেলা

সরস্বতী পূজা উপলক্ষে সিরাজগঞ্জ ও তাড়াশে প্রায় তিনশ বছর ধরে দইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবারও গতকাল রবিবার সকাল থেকে সিরাজগঞ্জ শহরের মুজিব সড়কে বাহারি স্বাদের দইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। মেলায় পাওয়া যাচ্ছে ক্ষীরসা দই, শাহী দই, টক দই, শ্রীপুরী দইসহ নানা বাহারি নামের দই। প্রতি বছর শীত মৌসুমের মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার দিন শ্রী পঞ্চমী তিথিতে দইমেলা শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় রবিবার সিরাজগঞ্জ শহরের মুজিব সড়কে এবং চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশ বাজারেও বসছে দইয়ের মেলা।
জানা যায়, তৎকালীন জমিদার পরম বৈষ্ণব বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর প্রথম দইমেলার প্রচলন করেন। নিজেও দই ও মিষ্টান্ন পছন্দ করতেন। তাই জমিদার বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে এ অঞ্চলে ঘোষদের তৈরি দই পরিবেশন করা হত। এলাকায় মানসম্পন্ন দই তৈরির কথা ভাবতেন বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর। এ কারণে জমিদার বাড়ির সামনে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে দিনব্যাপী দইমেলার প্রচলন শুরু করেছিলেন তিনি।
সুস্বাদু দইয়ের পরিবেশক রনি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের রনজিত ঘোষ বলেন, আজ (রবিবার) ২০ মণ দই নিয়ে এসেছি। দইয়ের চাহিদা থাকায় দুপুরের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা। তবে দুধের দাম, জ্বালানি, শ্রমিক খরচ, দইপাত্রের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দইয়ের দামও বেড়েছে।
বেলকুচি উপজেলার রাজাপুরের সুশান্ত ও রনজিত ঘোষ বলেন, জেলায় রাজাপুর ও এনায়েতপুরে দইয়ের একটা সুনাম রয়েছে। তাই আমাদের দইয়ের চাহিদা বেশি। কোনো ঘোষের দই অবিক্রীত থাকে না। বরং ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।
সিরাজগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সন্তোষ কুমার কানু ও জেলা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. সুকুমার চন্দ্র দাস বলেন, প্রায় তিনশ বছরের ঐতিহ্যবাহী দইমেলা প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এদিকে তাড়াশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে আজ সোমবার দিনব্যাপী এ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেলাকে ঘিরে এলাকায় সাজসাজ রব পড়ে গেছে। আগের দিন তাড়াশ ঈদগাহ মাঠে বিখ্যাত ঘোষদের দই আসার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। মেলায় দইয়ের পাশাপাশি ঝুড়ি, মুড়ি, মুড়কি, চিড়া, মোয়া, বাতাসা, কদমা, খেজুরের গুড় প্রভৃতি বেচাকেনা হয়।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রজত ঘোষ জানান, জমিদারি আমলে তাড়াশের তৎকালীন জমিদার পরম বৈঞ্চব বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর প্রথম রশিক রায় মন্দিরের মাঠে দইমেলার প্রচলন করেছিলেন।
এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে-তাড়াশ অঞ্চলে যারা জমিদারি করেছেন তাদের মধ্যে নাম, যশ, খ্যাতিতে অন্যতম জমিদার ছিলেন বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর। তিনি নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। এজন্য জমিদার বাড়ির সামনে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী দইমেলার প্রচলন শুরু করেন। সেই থেকে প্রতি বছর শীত মৌসুমের মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার দিন শ্রী পঞ্চমী তিথিতে দইমেলা বসছে। তৎকালে প্রতি বছর মেলায় আগত সবচেয়ে ভালো দই তৈরিকারককে জমিদারের পক্ষ থেকে উপঢৌকন দেওয়ার রেওয়াজও ছিল।
ক্ষীরসা দই, শাহী দই, চান্দাইকোনার দই, শেরপুরের দই, বগুড়ার দই, টক দই, ডায়াবেটিক দই, শ্রীপুরী দই এরকম হরেক নামের শত শত মণ দই বিক্রি হয়। এর মধ্যে বগুড়ার শেরপুর, রায়গঞ্জের চান্দাইকোনা ও ঘুড়কা, নাটোরের গুরুদাসপুরের শ্রীপুর, উল্লাপাড়ার ধরইল, পাবনার চাটমোহরের হান্ডিয়ালের দইয়ের আলাদা কদর আছে।
মহাদেব ঘোষ, বিমল ঘোষ, সুকুমার ঘোষসহ একাধিক ঘোষ জানান, সম্প্রতি দুধের দাম, জ্বালানি ও শ্রমিক খরচ, দই পাত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে দইয়ের দামও কেজিতে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বেড়েছে। তবে মেলা দিনব্যাপী হলেও চাহিদা থাকার কারণে কোনো ঘোষের দই অবিক্রীত থাকছে না।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সতেরো শতকে বাসুদেব তালুকদার নামে এক ব্যক্তি মুর্শিদাবাদের নবাবের অধীনে রাজস্ব বিভাগে চাকরি করতেন। তার সততা এবং নবাবের প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে তাড়াশ মহাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই থেকে তিনি তাড়াশ অঞ্চলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন।
বাসুদেবের পৌত্র বলরাম দাস ছিলেন নাটোর জমিদারির অধীন একজন কর্মচারী মাত্র। ১৭১১ সালে তিনি ‘রায়’ উপাধি গ্রহণ করেন। বলরাম রায়ের পঞ্চম পুরুষ রামসুন্দর রায় নিঃসন্তান হওয়ায় মূল বংশের বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু উত্তরাধিকারী ছিলেন চার দত্তক পুত্র। এদের মধ্যে তাড়াশের জমিদার বনোয়ারী লাল রায় অত্যন্ত খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ প্রতিষ্ঠায় অর্থ সহায়তা করেছিলেন। বনোয়ারী লাল রায়কে ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৪ সালে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেন। ১৯০৫ সালে তার মৃত্যুর পর দত্তকপুত্র বনমালী রায় তাড়াশের পরবর্তী জমিদার হন। তিনি পাবনা শহরে ‘ইলিয়ট বনমালী টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট’ এবং সিরাজগঞ্জে ‘বনোয়ারী লাল উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাবনায় অবস্থিত এডওয়ার্ড কলেজের নতুন ভবন নির্মাণেও এ জমিদার অর্থসহায়তা করেছিলেন। তিনিও ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯১৪ সালে তার মৃত্যু হয়। তখন তার দুই পুত্র ক্ষিতিশভূষণ ও রাধিকাভূষণ ১৯৫০ সালের জমিদারি প্রথা বিলোপ না হওয়া পর্যন্ত তাড়াশের জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন।
"