প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থানগাথা
অবশেষে ভিক্ষায় নেমেছেন শহীদ আকাশ ব্যাপারীর স্ত্রী লাকি

শহীদ আকাশ ব্যাপারী ছিলেন একজন রিকশাচালক। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে হতাহতদের নিয়ে মরণ ভয় তুচ্ছ করে ছুটে যেতেন হাসপাতালে। গুলিতে মরে যাওয়ার ভয়কে জয় করে তার মতো এরকম অসংখ্য আকাশ ব্যাপারী জুলাই আন্দোলনে আহত এবং নিহত মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। বিনিময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেননি কোনো টাকা-পয়সা। এমনকি তারা পুলিশ বা সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের কোনো রক্তচক্ষুকেও পরোয়া করেননি। আকাশ ব্যাপারীর রিকশার প্যাডেল এবং তার স্ত্রীর বাড়ি বাড়ি কাজ করে আনা টাকা দিয়ে তাদের সংসারটি কোনোরকমে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু দিন এনে দিন খাওয়া এ মানুষটির অনুপস্থিতিতে তার পরিবার এখন ভয়াবহ সংকটে। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে তাদের নিরেট উপবাসে দিন কাটছিল। উপায়ান্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আকাশের স্ত্রী এখন ভিক্ষায় নেমেছেন।
আকাশ ব্যাপারীর বয়স ছিল ৩৬ বছর। জন্ম নিবন্ধনে তার নাম মো. আকাশ। কিন্তু তিনি আকাশ ব্যাপারী নামেই পরিচিত। স্থায়ী ঠিকানা মাদারীপুরের হাবিঙ্গ ইউনিয়নের উত্তর দুধখালী গ্রামে। যদিও এখন সেখানে কিছুই নেই। মো. আজিজ ব্যাপারী ও মোসা. সামরতো বানের সন্তান তিনি। তার অন্য কোনো ভাই কিংবা বোন আছে কি না, তাও জানে না পরিবারটি। ভিটেমাটিহীন এ মানুষটিকে বিয়ে করেন কুমিল্লার মেয়ে লাকি আক্তার (৩৩)। তাদের কোলজুড়ে আসে দুটি সন্তান। থাকতেন রাজধানীর তুরাগের বাদালদি এলাকায়। বড় মেয়ে শারমিন আক্তার (১৫) স্থানীয় স্কুলে নবম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে শাহনাজ আক্তার (১২) অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এর মাঝে হঠাৎ করে তিনি কুড়িয়ে পান বাপ্পি (২২) নামের অপ্রকৃতিস্থ একটি ছেলেকে। যাকে তিনি নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখতেন। তার টয়লেট-গোসল থেকে খাওয়া-দাওয়া সব তিনি নিজহাতে করে দিতেন।
শোকে মুহ্যমান শহীদের স্ত্রীর মুখে কোনো কথাই যোগাচ্ছিল না। তবু তিনি বাপ্পি প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছেলেটিকে আমার স্বামী খুবই আদর করত এবং নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। সারা দিন রিকশা চালিয়ে রাতে বাসায় এসে ওকে নিজহাতে গোসল করিয়ে খাইয়ে দিতেন। আমাদের বলতেন, তোমরা ওর কাজ করতে পারবা না। আমি খেয়ে থাকি, না খেয়ে থাকি ওকে দেখে রাখব। যতদিন বেঁচে থাকি ভিক্ষা করে হলেও ওর পাশে আমি থাকব।’
গত ৫ আগস্ট আকাশ ব্যাপারী তার রিকশা নিয়ে বের হন।
এর আগে প্রতিদিনই তিনি আন্দোলনে সহায়কের ভূমিকায় ছিলেন। ফলে ভয়ে তার বড় মেয়ে কোনোভাবেই বাসা থেকে তাকে বের হতে দিতে চাচ্ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে বড় মেয়ে শারমিন বাসসকে বলেন, ‘আমি বাসায় ভেতর থেকে তালা মেরে চাবি লুকিয়ে রাখতাম। যেন তিনি বের হতে না পারেন। বাবাকে বলতাম, বাবা তুমি ছাড়া তো আমাদের আর কেউ নেই। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কী হবে? কিন্তু ঐদিন কাউকে কিছু না বলে তিনি বের হয়ে যান। আমরাও ভাবছিলাম, আজকে যেহেতু বিজয় হয়েছে তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না।’ শারমিন বলতে থাকেন, ‘কিন্তু ৫ তারিখ সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। বাবা বাসায় আসে না। পরের দিন আমরা সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করি, কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পাই না।
এরপরে টানা পাঁচদিন খুঁজতে খুঁজতে যখন কোনোভাবে কূলকিনারা করতে পারছিলাম না, তখন একটি লিফলেট ছাপাই। যে লিফলেটটি ১১ তারিখ জসীমউদ্দীন মোড় থেকে হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে আমরা দিই। তারপরে ওই লিফলেটটি পেয়ে সালেহ রায়হান ভাই সরাসরি ফোন করেন। আমরা ভাবতেই পারিনি, বাবা আর নেই। তাই তিনি যখন বলেন যে, এ ছবির সঙ্গে তাদের একজন শহীদের মিল আছে, আমরা প্রথমে বিশ্বাসই করিনি। পরে তিনি বাবার ছবি আমার হোয়াটস্অ্যাপে দেন। ছবি দেখেই তো মা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। তখন তিনি বলেন, আত্মীয়-স্বজন না আসাতে আজকে সকালেই এ লাশটি আমরা ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দিয়েছি। গত ছয়দিন যাবত কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে পড়েছিল।
শারমিন বলেন, ‘আমরা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাই। কিন্তু হাসপাতালের লোকজন মাকে ছাড়া বাবার লাশ আমাদের দেবে না। তখন মাকে আনতে আমরা আবার উত্তরা যাই। তারপর মাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরে বাবার লাশ বুঝে পাই।’ দেশের বাড়ির ঠিকানাও হারিয়ে গেছে আকাশ ব্যাপারীর। তাই কবর হয়েছে বাউনিয়া, তুরাগেই। মানুষের বাড়িতে কাজ করে শহীদের স্ত্রীর মোট আয় ৮ হাজার টাকা। ঘরভাড়া ৭ হাজার। বাকি ১ হাজার দিয়ে তারা কীভাবে চলবেন? তাই বাকি খরচ জোগাতে ভিক্ষায় নামতে হয়েছে লাকিকে। একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ টাকা দিলেও আকাশ ব্যাপারীর ঋণ ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার। এখন যে ঢাকা থেকে চলে যাবে সেই উপায়ও নেই। কারণ গ্রামের বাড়িতেও যাওয়ার অবস্থা নেই। গ্রামে কোনো ঘরবাড়ি না করেই কবরে শুয়ে আছেন শহীদ আকাশ। এ শহীদ কিছুটা বাউল স্বভাবের ছিলেন। কিন্তু পাক্কা বিশ্বাসী ছিলেন যে ভালো কাজের প্রতিদান আল্লাহ পরকালে দেবেন। আকাশ ব্যাপারী মরে গেছেন ঠিকই তবে মেরে যাননি চারটি মুখ। এটা কি তার অপরাধ?
কাঁদতে কাঁদতে শহীদের বড় মেয়ে বলেন, ‘জুলাই রেভ্যুলেশনারি অ্যালায়েন্সের সালেহ রায়হান ভাই যদি আমাদের পাশে না থাকতেন, তাহলে যে কী হতো! অর্থাভাবে আমাদের দুই বোনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাই আমাদের স্কুলের টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এছাড়াও যেকোনো সমস্যায় একটা ফোন দিলেই ভাই ছুটে আসেন বা সমস্যার সমাধান করে দেন। অথচ তিনি নিজেও একজন ছাত্র। বিভিন্নজনের কাছে বলেকয়ে আমাদের পরিবারটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।’
উল্লেখ্য, জুলাই আন্দোলন নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘জুলাই রেভ্যুলেশনারি অ্যালায়েন্স’। জুলাই আন্দোলনের সামনের সারির যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত এ সংগঠন। এর আহ্বায়ক ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালেহ মাহমুদ রায়হান। তিনি জানান, উত্তরা তিন নাম্বার সেক্টর মসজিদে প্রতি শুক্রবার আকাশের স্ত্রী ভিক্ষা করেন। আর বাকি ছয়দিন মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে সন্তান তিনটির মুখে অন্ন যোগান। সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হয়ে রাত সাড়ে আটটায় তিনি বাসায় ঢোকেন। সব দেখেশোনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত লাইনটা মনে পড়ে গেল। ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে...।’ আকাশ ব্যাপারী একজন রিকশাওয়ালা ছিলেন। তিনি সমাজের তথাকথিত ভদ্র শ্রেণিভুক্ত ছিলেন না। তাই হয়ত আকাশ অনেকটা হিসাবের বাইরে পড়ে আছেন। আজ তার অসহায় পরিবারের পাশে কেউ নেই। সমাজ নেই, বিত্তবান নেই। অথচ পরিবারটির পাশে সবারই দাঁড়ানো দরকার এবং এক্ষুণি।
"