রংপুর ব্যুরো

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

পাঁচ কোটি টাকার ডিজিটাল ল্যাব কাজে আসছে না

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে প্রায় ৫ কেটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে স্থাপিত ডিজিটাল যন্ত্রপাতি কাজে আসছে না। প্যাথলজি বিভাগে রসায়ন দ্রবাদি (রি-এজেন্ট) সরবরাহ না থাকায় এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তাই প্রায় আড়াই বছর ধরে পুরাতন যন্ত্রপাতি দিয়ে ‘এনালগ’ বা ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতে এখন হাসপাতালে রোগ নির্ণয় করা হচ্ছে। এতে যেমন কালক্ষেপণ হচ্ছে তেমনি রোগীর চিকিৎসায় ভোগান্তি বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে চরম বিপাকে পড়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসক ও রোগীরা।

তবে হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করবেন। এছাড়াও প্যাথলজি বিভাগের রিপোর্ট সংক্রান্ত কার্যক্রম কম্পিউটারাইজড করারও উদ্যাগ নেবেন।

রোগীর অভিযোগ ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের একশ্রেণির চিকিৎসক, কর্মচারী ও বেসরকারি ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠান বা প্যাথলজিক্যাল ক্লিনিক মালিকদের একটি চক্র হাসপাতালের অত্যাধুনিক ডিজিটাল যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করার নেপথ্যের কারিগর। কারণ আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে দিনে যে পরিমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় সে অনুপাতে ‘এনালগ’ বা ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতে দিনে সিকিভাগও করা সম্ভব নয়। ফলে রোগ নির্ণয়ের জট এড়াতে রোগীরা হাসপাতালের আধুনিক ডিজিট্যাল প্যাথলজিক্যাল সুবিধা না পেয়ে হাসপাতালের বাইরে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক বা প্যাথলজিক্যাল ক্লিনিকে রোগ নির্ণয় করাচ্ছেন। আর এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কমিশন এজেন্ট হিসেবে হাসপাতালের ভেতরই কাজ করছেন চিকিৎসক, কর্মচারীসহ একটি দালাল চক্র। এ কারণে হাসপাতালে ওই মেশিন দুটির জন্য রি-এজেন্ট সরবরাহের একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, ডিজিটাল অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে রোগ নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদন ‘রি-এজেন্ট’ বা ‘বিকারক’ যা একটি রাসায়নিক উপাদান। নির্ভুল রোগ নির্ণয়ের জন্য এ রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। তাই রংপুর বিভাগের আট জেলার একমাত্র বৃহৎ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে ও সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য বিগত সরকার আমলে ২০২২ সালের শেষের দিকে হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে স্থাপন করা হয় অত্যাধুনিক দুটি মেশিন। এর মধ্যে অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন যার মাধ্যমে রক্তের গ্লুকোজ ও সিরাম ক্রিয়েটিনিন অর্থাৎ ডায়াবেটিস ও কিডনির রোগ নির্ণয় করা হয়। আর অটোমেটিক সেল কাউন্টার মেশিন। এ মেশিনের মাধ্যমে ‘কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট’ (সিবিসি) করা হয়। ‘স্যাম্পল’ হিসেবে মেশিন দুটির সঙ্গে সেসময় সরবরাহ করা রি-এজেন্ট ওই বছরের নভেম্বরেই শেষ হয়ে যায় বলে হাসপাতালের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। সেই সময় থেকে রহস্যজনক কারণে ওই দুটি মেশিনের জন্য ব্যবহৃত রি-এজেন্ট বা রাসায়নিক দ্রবাদি সরবরাহ করা হয়নি। মেশিন দুটি চালানোর জন্য হাসপাতালের টেকনিশিয়ানের সক্ষমতা রয়েছে। শুধু রি-এজেন্ট সরবরাহ না থাকায় প্রায় আড়াই বছর ধরে ওই মেশিন দুটি অবহেলায় পড়ে আছে। অতি পুরাতন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ‘এনালগ’ বা ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতে।

তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগে প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট সরবরাহ না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। অনেক সময় অ্যানালগ পদ্ধতিতে সঠিক রোগ নির্ণয় করা যাচ্ছে না। এছাড়া মূল্যবান যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত পড়ে থাকায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চাহিদা অনুপাতে রোগ নির্ণয়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যে ব্যাপক রোগীর চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছেন প্যাথলজি বিভাগের সীমিত চিকিৎসক ও কনোলজিস্টরা। প্রতিদিন হাসপাতালে প্রায় ৭শ থেকে ১ হাজার রোগীর রোগ নির্ণয়ের জন্য প্যাথলজি বিভাগে আসেন। এর মধ্যে ‘এনালগ’ বা ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতে মাত্র ১শ থেকে দেড় শতাধিক রোগীর রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। আর বাকি রোগীরা বাইরে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠান বা প্যাথলজিক্যাল ক্লিনিকগুলো থেকে রোগ নির্ণয় করাতে বাধ্য হচ্ছেন। রমেক হাসপাতালের ডিজিটাল ল্যাব চালু থাকলে সেখানে প্রায় সাড়ে ৪শ থেকে ৬ শতাধিক রোগীর রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হত। এতে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় কমে হত। ভোগান্তির শিকার হতে হত না।

এ ব্যাপারে হাসপাতারের ল্যাব টেকনোলজিস্ট মো. আলী আজম বলেন, ‘রি-এজেন্ট সরবরাহ না থাকায় অত্যাধুনিক মেশিন বন্ধ রয়েছে। পুরাতন মেশিন দিয়ে এনালগ পদ্ধতিতে সব পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে সময় বেশি লাগছে। আবার অধিকাংশ বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রিপোর্টের কাগজ কম্পিউটারাইজ হয়ে গেছে। সেখানে রমেকের প্যাথলজি বিভাগের কার্যক্রম এখনো ল্যাবরেটরি ইনফরমেশন সিস্টেমের (এলআইএস) মধ্যে আনা হয়নি। প্রতিটি রিপোর্ট হাতে লিখতে হচ্ছে।

রমেক হাসপাতাল এবং কয়েকটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, রমেকের প্যাথলজি বিভাগে সিবিসি পরীক্ষা করতে ফি নেওয়া হয় ১৫০ টাকা। সিরাম ক্রিয়েটিনিন ৫০ টাকা এবং ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষা ৬০ টাকা। বিপরীতে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিবিসি করতে নেওয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা, সিরাম ক্রিয়েটিনিন ৪০০ এবং ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষায় নেওয়া হচ্ছে ১৫০ টাকা। এ কারণে রোগীদের স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার যে উদ্যোগ তা কাজে আসছে না।

হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শিহাব রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘রি-এজেন্ট সরবরাহ না থাকায় অত্যাধুনিক অটোমেটিক সেল কাউন্টার এবং অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন চালু করা যাচ্ছে না। অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন ২০১৯ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। এটি চালু করার কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। সিবিসির ক্ষেত্রে মাইক্রোস্কোপে পেরিফেরাল ব্লাড স্মেয়ার দেখে রোগ নির্ণয় করা হয়। বর্তমান আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের যুগে এ পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম। এছাড়া অন্যান্য পরীক্ষাও অ্যানালগ পদ্ধতিতে করতে হচ্ছে। এতে সময় অপচয় হচ্ছে। প্যাথলজি বিভাগে একদিনে যে পরিমাণ পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে অটো মেশিনগুলো চালু থাকলে তা ২-৩ ঘণ্টায় করা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘মূল্যবান অত্যাধুনিক মেশিনগুলো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকলে এর মধ্যে থাকা মোটর, ভাল্ব, মুভিং অপশন, বিশেষ করে অপটিক্যাল মডিউল (ড্যাম বা ড্যামেজ) এবং অন্য সূক্ষ্ম পার্টস নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি একাধিকবার হাসপাতালের পরিচালককে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।’

এ ব্যাপারে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, তিনি সদ্য যোগদান করেছেন। এখনো বিষয়টি তার নজরে কেউ আনেননি। তারপরও এখন সব কিছুই অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা দ্রুত দরপত্র আহ্বান করব। আশা করি দুই-তিন মাসের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে।’ এছাড়া প্যাথলজি বিভাগের রিপোর্ট সংক্রান্ত কার্যক্রম কম্পিউটারাইজড করার উদ্যোগ নেবেন বলে জানান তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close